বিধিনিষেধের মধ্যে ৯৫ শতাংশ বাস ও লেগুনা চালাতে এবং ৮০ শতাংশ দোকানপাট খুলতে পারেননি মালিকেরা।
পরিবহন খাতের প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতির মুখের পড়েন।
বিদায়ী ২০২১ সালে লকডাউন তথা বিধিনিষেধের সময়ে রাজধানী ঢাকায় পরিবহন, দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের ৮৭ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারিয়েছিলেন। এই শ্রমিকদের ৭ শতাংশ এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। এ ছাড়া বিধিনিষেধ চলাকালে এই তিন খাতের শ্রমিকদের মোট আয় কমেছে প্রায় ৮১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ঢাকা শহরের পরিবহন, দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের ওপর বিধিনিষেধের প্রভাব নিরূপণে বিলস এই গবেষণা করে। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজস্ব সেমিনার হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিলসের গবেষণা বিভাগের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) নেতা আমিরুল হক আমিন এবং বিলসের দুই পরিচালক কোহিনূর মাহমুদ ও নাজমা ইয়াসমীন।
গত বছর বিধিনিষেধের সময়ে রাজধানী ঢাকায় পরিবহন, দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ—এই তিন খাতের ৮১ শতাংশ শ্রমিকের আয় কমেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিলস জানায়, দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় ধাপের বিধিনিষেধের কারণে ঢাকা শহরে আলোচ্য তিন খাতের শ্রমিকেরা কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তা জানার জন্য এই গবেষণা করা হয়েছে। এতে বিধিনিষেধের সময় শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, আয়ের ওপর প্রভাব, সামাজিক সুরক্ষা ও ক্ষতি পুনরুদ্ধারের তথ্য খোঁজা হয়েছে। এ জন্য শ্রমিকদের বিধিনিষেধের আগের অবস্থার সঙ্গে বিধিনিষেধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ের তুলনা করে পরিস্থিতি যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, বিধিনেষেধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন পরিবহন খাতের শ্রমিকেরা। এই খাতের প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতির মুখের পড়েন। আর দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে কাজ হারানোর হার ছিল প্রায় ৮৩ শতাংশ। তিন খাত মিলিয়ে কাজ হারান ৮৭ শতাংশ শ্রমিক। তবে বিধিনিষেধের সময়ে এসব খাতে পূর্ণকালীন কাজ কমলেও খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন বিধিনিষেধের সময় যেখানে পূর্ণকালীন কাজ কমেছে ৯৭ শতাংশ, সেখানে খণ্ডকালীন কাজ বেড়ে দাঁড়ায় ২১৫ শতাংশ।
বিলসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিধিনিষেধকালে শ্রমিকেরা সপ্তাহে ছয় কর্মদিবসের মধ্যে মাত্র এক দিন কাজ করতে পেরেছেন। সে হিসাবে মোট কর্মদিবস কমেছে ৮৫ শতাংশ। আর মোট কর্মঘণ্টা কমেছে ৯২ শতাংশ। দুই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবহন খাত। বিধিনিষেধের মধ্যে ৯৫ শতাংশ বাস ও লেগুনা চালাতে এবং ৮০ শতাংশ দোকানপাট খুলতে পারেননি মালিকেরা।
কাজ হারানোর পাশাপাশি আয়ের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধের সরাসরি প্রভাব পড়ে। ওই সময়ে আলোচ্য তিন খাতের শ্রমিকদের মোট আয় কমেছে প্রায় ৮১ শতাংশ। তবে এককভাবে ৯৬ শতাংশ আয় হ্রাস পেয়েছে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের। আর তাঁদের পারিবারিক আয় কমেছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।
বিলস জানায়, শ্রমিকেরা কাজে ফিরলেও আগের তুলনায় সার্বিকভাবে তাঁরা এখনো ৮ শতাংশ কম আয় করছেন। অন্যদিকে বিধিনিষেধের সময়ে যাঁরা কাজে টিকে ছিলেন, তাঁদের প্রায় ৭৯ শতাংশেরই বেতন ছিল অনিয়মিত। অনিয়মিত বেতন পাওয়ার হার বর্তমানে ৩৩ শতাংশ। ফলে এই সময়ে শ্রমিকদের আয়–ব্যয়ের পার্থক্য বেড়েছে ৭৭ শতাংশ।
তবে ওই সময়ে এই তিন খাতের প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ) শ্রমিক তাঁদের মালিকদের কাছ থেকে খাদ্য, বোনাস বা থাকার জায়গা প্রভৃতি সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু এসব খাতে সরকারি সহায়তার পরিমাণ ছিল ১ শতাংশের কম।
বিলসের গবেষণা বিভাগের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম জানান, সরকার ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও বিধিনিষেধের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই তিন খাত তেমন সহায়তা পায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা ৪০০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, এর মধ্যে মাত্র তিনজন সরকারি সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান।’
করোনার টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছেন এই তিন খাতের শ্রমিকেরা। গবেষণায় দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ শ্রমিক করোনার টিকা পেয়েছেন।
বিলস জানায়, গবেষণায় ঢাকাকে ছয়টি এলাকায় ভাগ করে পরিবহন, দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের ৪০০ জন শ্রমিকের তথ্য নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এসব খাতের মালিকপক্ষের ৩০ জন এবং ট্রেড ইউনিয়ন, সরকারের প্রতিনিধি, এনজিও, সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞে মিলিয়ে আরও ২৫ জনের মতামত নেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মো. মনিরুল ইসলাম ১০টি সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করতে গিয়ে এই তিন সেক্টরের শ্রমিকদের কোনো ডেটাবেজ পাইনি। তাঁদের ক্ষতি নিরূপণ এবং সহায়তা প্রদানের জন্য একটি ডেটাবেজ খুবই প্রয়োজন। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ জরুরি সহায়তা তহবিল গঠন, করোনার টিকা ও চিকিৎসা প্রদান, বিমা ব্যবস্থা প্রবর্তন, ব্যাংকঋণের শর্ত শিথিল, চাকরির নিশ্চয়তা এবং ট্রেড ইউনিয়নের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনি।