বিএফআইইউর ২০ বছর

কাজের পরিধি বাড়লেও অর্থ পাচার কমেনি

দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি বেশ আলোচিত। নতুন বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়ায় তা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা চলছে। কিন্তু দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাবে কে, পাচারকারীদের ধরবেই বা কে—এই আলোচনা উঠলে প্রথমেই আসে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নাম। এটি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট নামেও পরিচিত। আইন অনুযায়ী, এই ইউনিটটি সরকারের স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করছে। তবে বিএফআইইউ কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, এটি শুধু আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন পেশ করতে পারে।

ধীরে ধীরে এই ইউনিটের কাজের পরিধি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকিং লেনদেনে অনেকটা স্বচ্ছতা এসেছে। তবে প্রভাবশালী অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে এই ইউনিটের কাজের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ফলে কাজের পরিধি বাড়লেও দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছেই। এই ইউনিটের ২০ বছর পূর্তি আজ সোমবার।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত দুই দশকের মধ্যে গত বছরই সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের নামে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।

কেমন করছে বিএফআইইউ—জানতে চাইলে সংস্থাটির সাবেক উপপ্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিএফআইইউর কাজ হলো, দেশ বা বিদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আর্থিক গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রস্তুত করা। সেই রিপোর্ট দেশীয় তদন্ত সংস্থাগুলোকে সরবরাহ করা হয়। তারা ব্যবস্থা নেয়। তবে সমস্যা হলো, এখন সবার বিষয়ে আর্থিক গোয়েন্দা রিপোর্ট করতে পারছে না। আবার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও লোকবলের ঘাটতি আছে। এখন যে পরিবেশ তাতে কাজের আগ্রহও কমে গেছে।

জানা যায়, ১৯৮৯ সালে জি-২০ দেশগুলো মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের লক্ষ্যে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এফএটিএফের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নকারী সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। বিশেষ করে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধব্যবস্থার প্রেক্ষাপট পাল্টে দেয়।

বাংলাদেশ ২০০২ সালে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করে। ওই বছরই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ নামে বাংলাদেশ ব্যাংক পৃথক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বিভাগটিই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) রূপান্তর হয়। বিএফআইইউ এখন সরকারের একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করছে। গভর্নর এই ইউনিটের রিপোর্টিং প্রধান। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাই এই ইউনিট পরিচালনা করেন।

বিএফআইইউ একসময় শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য নিতে পারত। এখন শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বিমা প্রতিষ্ঠান, জুয়েলারি দোকানসহ ১৭টি খাত থেকে তথ্য নিতে পারে বিএফআইইউ। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে এই সংস্থার গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানোর হারও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন তদন্তকারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ১ হাজার ৪৮১টি গোয়েন্দা প্রতিবেদন বা আর্থিক তথ্য বিনিময় করে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৯০৩টি।

আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের তথাকথিত সেকেন্ড হোমে যাওয়া, সিঙ্গাপুরের তারকা হোটেলের মালিকানা নেওয়া ও সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা এখন বহুল আলোচিত বিষয়। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর অর্থ পাচারের বিষয় ইদানীং মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। কিন্তু এসব বিষয়ে বিএফআইইউর কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ ধরনের নির্লিপ্ততার কারণে বিএফআইইউর কাজের পরিধি ও প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়লেও দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ হচ্ছে না।

বিএফআইইউর সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ১০ বছর আগেও যাঁদের নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন করা যেত, এখন তা কল্পনাও করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে যেমন চাপ রয়েছে, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা এগোতে চায় না। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ইউনিটটির কার্যক্রম।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও বিএফআইইউর কর্মকর্তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।