বাংলাদেশ ব্যাংক

কাউকে ‘অখুশি’ না করেই বিদায় ফজলে কবিরের

৩ জুলাই বিদায় নিয়েছেন রিজার্ভ চুরির পর দায়িত্ব নেওয়া গভর্নর ফজলে কবির। ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক কাজের জন্য সমালোচিতও তিনি।

ফজলে কবির
ফজলে কবির

রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বসে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার কমানোর। ওই সভার পর ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমে যায়।

সাধারণত নানা আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই নীতি সুদহার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে এই সুদহার কমানোর ঘটনা ঘটে হোটেলে বসে তাৎক্ষণিক এক আলোচনায়।

আর ২০১৯ সালের মে মাসে খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়।

এই তিনটি সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় সদ্য বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবিরের আমলে। তবে মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায় এ কথা প্রচলিত, এসব সিদ্ধান্ত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। কোনোটিই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল না। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, যার রয়েছে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা ও আইনি ক্ষমতা।

নিজেদের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব সিদ্ধান্তের বড় উপকারভোগী ছিলেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকমালিকেরা। তাই স্বাভাবিকভাবে এই পক্ষের কাছে গভর্নর ফজলে কবির ছিলেন পছন্দের ব্যক্তি।

আবার ব্যাংক খাতে ন্যূনতম বেতন–ভাতা নির্ধারণ, চাকরির নিশ্চয়তাবিধানসহ নানা পদক্ষেপের কারণে শেষ সময়ে এসে সাধারণ ব্যাংকারদের কাছেও প্রিয় গভর্নর হয়ে ওঠেন তিনি। একইভাবে সুদহার কমলেও আমানতকারী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেই উদ্যোগও নিয়েছিলেন।

এভাবে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে সবাইকে খুশি করেছেন সদ্যবিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির। সবাইকে খুশি করায় উপহার হিসেবে সরকার আইন পরিবর্তন করে তাঁকে ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত গভর্নর পদে রাখে। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে গত রোববার (৩ জুলাই) পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ঈদের ছুটির পর নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ১ দেবেন অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার।

গভর্নর হিসেবে ফজলে কবিরের প্রশংসা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে সমালোচনাও। সবচেয়ে বড় সমালোচনা, তাঁর সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে মান হারিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আবার তাঁর সময়েই কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনায় পরিবর্তন আসে ‘অস্বাভাবিক পন্থায়’। বিদেশে অর্থ পাচার ও ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেওয়াও বন্ধ হয়নি। বরং বড় ও প্রভাবশালী গ্রাহকদের দৌরাত্ম্য কয়েক গুণ বেড়েছে ব্যাংক খাতে। যাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ সময়ে এসে মার্কিন ডলার নিয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতির মুখে পড়েন তিনি। বিদায় নেন সেই সংকট রেখেই।

আলোচনা- সমালোচনার এসব বিষয়ে ফজলে কবিরের বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে গত বৃহস্পতিবার মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘সাবেক গভর্নরদের কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নেই। তাঁরা বলেন, এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে। এটা অসম্ভব। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।’

যত ভালো উদ্যোগ

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতে বিদায়ী গভর্নরের ভালো উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম অকারণে চাকরিচ্যুত ব্যাংকারদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনাটি। যদিও সেটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এ ছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ। সব ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করলেও এতে স্বস্তি পেয়েছেন ব্যাংকাররা।

ঋনের সুদ একক অঙ্কে নামিয়ে আনায় কমে গিয়েছিল আমানতের সুদহারও। এই সুদহার নেমে আসে মাত্র আড়াই থেকে তিন শতাংশে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন সুদ বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানিয়ে দেয়, মেয়াদি আমানতের সুদহার গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। ফলে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে উন্নীত হয়, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে স্বস্তি দিয়েছে আমানতকারীদের।

ব্যাংকগুলো কোন সেবার বিপরীতে কত মাশুল নিতে পারবে, তা গত বছরের জুনে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে স্বস্তি পান ছোট আমানতকারীরা।

করোনাকালে প্রণোদনা প্যাকেজ

ব্যবসায়ীদের করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এসব প্যাকেজের গড় সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। এর ফলে বিপর্যস্ত অর্থনীতি অল্প সময়েই ঘুরে দাঁড়ায়।

সমালোচনা যা নিয়ে

ফজলে কবিরের বিরুদ্ধে বড় সমালোচনা, তাঁর সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নীতি গ্রহণ ও নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বল হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনেক ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব কাজ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—চাপিয়ে দেওয়া সুদহার বাস্তবায়ন, নীতিনির্ধারণী সুদহার পরিবর্তন এবং শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিশেষ তহবিল থেকে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান।

জোরপূর্বক মালিকানা পরিবর্তন

গভর্নর ফজলে কবিরের সময়ে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভীর রাতে অনুমোদন দেয় বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও একাধিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবিরের সময়ে আর্থিক খাতের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ

ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণ কমাতে গভর্নর ফজলে কবির ২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়মিত করার উদ্যোগ নেন। আর করোনার কারণে ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ায় প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য আড়াল হয়ে যায়। ফলে খেলাপি ঋণ যা দেখাচ্ছে, বাস্তবে তার কয়েক গুণ বেশি হবে। তিনি যখন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। আর গত মার্চ মাসের শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।

ডলার–সংকট

এখন ডলার–সংকট বাংলাদেশ ব্যাংককে বিপদে ফেলেছে। ডলার–সংকটের পরিস্থিতিতে সংস্থাটি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশেষে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আবার পেছন থেকে লাগামও ধরে রাখতে চাইছে। গত দুই মাসে ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সায় উঠেছে।

মুদ্রানীতি ঘোষণা

আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দুবার সংবাদ সম্মেলন করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করত। সেই প্রবণতায় ভাটা পড়ে গভর্নর ফজলে কবিরের সময়ে। প্রথমে বছরে দুবারের পরিবর্তে একবার তা ঘোষণা করা হয়, পরে করোনার কারণে বিজ্ঞপ্তি দিয়েই তা জানানো হয়। অবশ্য বিদায়ের আগে সাংবাদিক ডেকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন আর বলিষ্ঠ কণ্ঠে জবাব দেন জমে থাকা বিভিন্ন প্রশ্নের।

দীর্ঘমেয়াদি গভর্নর

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করলে তাড়াহুড়ো করে পরদিনই সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য গভর্নর নিয়োগ দেয় সরকার। তখন তিনি বিদেশে ছিলেন। বিদেশ থেকে ফিরে ২০ মার্চ তিনি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেই হিসাবে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালরে ১৯ মার্চ। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন আগে গভর্নর হিসেবে তাঁর মেয়াদ ৩ মাস ১৩ দিন বাড়ায় সরকার। বলা হয়, ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি গভর্নর থাকবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশে কাউকে চার বছরের জন্য গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা থাকলেও সরকার মেয়াদ আরেক দফা বাড়াতে পারে বলে অধ্যাদেশে বলা আছে। ফজলে কবিরের বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হয় ২০২০ সালের ৩ জুলাই। তার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধন করে তাঁর মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী ৩ জুলাই জন্মদিনেই শেষ হবে তাঁর মেয়াদ।

ফজলে কবির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালনকারী গভর্নর। তাঁর চেয়ে বেশি সময় গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এম নূরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৃতীয় গভর্নর, যিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম আমলা গভর্নর। গভর্নর ফজলে কবিরও ছিলেন আমলা। নতুন গভর্নরও আমলা ।

ফলে সামনের দিকে আর্থিক খাত কোন দিকে যাবে, সেটা এখন দেখার বিষয়।