করোনার শিক্ষা কতটা কাজে লাগছে

বিশৃঙ্খল স্বাস্থ্য খাতকে পথে আনতে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বড় ধরনের কোনো ঘোষণা থাকছে না। টাকার অঙ্কে প্রতিবারের মতো এবারও শুধু বরাদ্দই বাড়ানো হচ্ছে। তাও আবার বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের নিচেই থাকছে। করোনার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে এবার ব্যতিক্রমী বাজেট ঘোষণার কথা বলা হলেও বড় ধরনের কোনো সংস্কারের কর্মসূচি নেই এতে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দেশের গোটা চিকিৎসা খাতের প্রকৃত চিত্র কেমন, তা আর কাউকেই বলতে হবে না। সবাই তা বুঝতে পারছেন। অন্যদিকে নতুন বাজেট সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তা থেকে বলা যায়, করোনা ভুলে গিয়েও যদি সারা বছরের সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে খেয়ালি-খ্যাপাটে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমন কাউকে পাওয়া দুষ্কর হতে পারে, যিনি বলবেন, সবকিছু ঠিক আছে। তাহলে কী দাঁড়াল? করোনা থেকে কী শিক্ষা নিলাম আমরা? এই প্রশ্নটাই উঠতে পারে নতুন বাজেট নিয়ে।

বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার প্রাক্কালে এখনো কেন মানুষকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বারান্দায় শুয়ে চিকিৎসা নিতে হবে? ঢাকা মেডিকেলের মতো আরও এক থেকে দুটি মেডিকেল কলেজ কি এই মুহূর্তে জরুরি নয়?

আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজেট তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য কী বার্তা নিয়ে আসছে? বাজেটের তো একটি বড় অংশই বরাদ্দ থাকবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ, ভর্তুকি-প্রণোদনা ইত্যাদি খাতে।

জানা গেছে, সাধারণ মানুষের মৌলিক চিকিৎসা, করোনার কারণে নতুন করে অতি গরিব হয়ে যাওয়া মানুষের অন্ন ও বিদেশ থেকে ফিরে আসা কয়েক লাখ মানুষের কাজের সংস্থানে কী করা হবে, সেই ব্যবস্থাও থাকছে না বাজেটে। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা, আমদানি-রপ্তানির গতি কমে যাওয়া, উৎপাদনশীল কারখানা বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকছে।

>আজ আরেকটি গতানুগতিক বাজেটই দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী
এতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, আয়ের নতুন উৎস খোঁজা ও ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ থাকবে না

পাঁচ বছর আগে থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ঘোষণা প্রতিবারের বাজেটেই থাকছে। কিন্তু বেসরকারি খাত এবং বয়স্ক মানুষেরা আশায় বুক বেঁধেও শেষ পর্যন্ত গুড়েবালিই দেখছেন। এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না বলেই জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তন দরকার। এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা দরকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বরাদ্দ বাড়বে, সংস্কার হবে, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব আসবে—সব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলবে। এমনকি বাজেটে কী করতে হবে, সে ব্যাপারেও কাউকে পরামর্শ দিতে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সদিচ্ছা ও তার প্রতিফলন আমরা কবে দেখতে পাব? সৈয়দ আবদুল হামিদ মনে করেন, অ্যাডহক ভিত্তিতে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে কোনো কাজ হবে না।

আয় নেই, আয় নেই

বাজেটের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে একধরনের হাতে ধরে পথ চলার বিষয় আছে। আয় না হলে খরচের পথ সুগম হয় না। আবার খরচ করার সামর্থ্য না থাকলে কাঙ্ক্ষিত আয় না হলেও বাজেট বাস্তবায়নে সমস্যা হয় না। আয় করার সক্ষমতা নেই, আবার ব্যয়ের সক্ষমতাও নেই। এভাবেই চলে আসছে বাংলাদেশের বাজেট বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সরকারের আয় আহরণের অন্যতম বড় মাধ্যম। বাজেটের সিংহভাগ টাকার জোগান দেয় এই এনবিআর। কিন্তু এনবিআরে জনবলসংকটের পাশাপাশি রয়েছে কাঠামোগত সমস্যাও। তাই আয় করার পথও বের করতে পারে না সরকার। যেমন এক বছর ধরে চেষ্টা করেও সরকার ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কিনতে পারেনি।  তারপরও সংস্থাটিকে প্রতিবছর সক্ষমতার চেয়ে বড় লক্ষ্য দেওয়া হয়। এ যেন ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই কাউকে বলা, যুদ্ধ করতে যাও। অবশ্য প্রতিবারই অর্থবছরের শেষ দিকে গিয়ে লক্ষ্য কমিয়ে আনা হয়। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরেও তা করা হয়েছে।

কিন্তু করোনা এবার রাজস্ব আদায়ে বড় আঘাত করেছে। করোনার কারণে গত এপ্রিল ও মে মাসে রাজস্ব আদায়ে গতি একদম ছিল না বললেই চলে। মে মাসের হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। এপ্রিল মাসে ১৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল, আদায় হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। অবশ্য সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসে অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই রিটার্ন জমা দিতে পারেনি। সীমিত পরিসরে আমদানি চালু থাকায় এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য তিন ভাগের এক ভাগ অর্জিত হয়েছে।

সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা টাকা। চলতি অর্থবছরের এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এদিকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে আদায় হতে পারে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

এমন অবস্থায় আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে এনবিআরকে। সবচেয়ে বেশি আদায় করতে হবে ভ্যাটে, ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া আয়করে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকার লক্ষ্য থাকছে।

স্বাভাবিক সময়েও খরচের দক্ষতা নেই

করোনার কারণে বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন মার খাচ্ছে। বিদেশি প্রকৌশলীরা এগুলোতে কাজ করেন। তাঁদের অনুপস্থিতির জন্য এবার প্রকল্পের কাজ আটকে ছিল কিংবা শ্লথ হয়ে পড়েছে। যেমন চীনা প্রকৌশলীরা করোনার কারণে চীন থেকে ফেরত আসতে না পারায় ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে পদ্মা সেতুর কাজ খুব একটা এগোয়নি। মার্চ ও এপ্রিলে পদ্মা সেতুর মাত্র ২ শতাংশ কাজ এগিয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মোট ৭৯ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজেও গতি কমেছে।

চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সংশোধিত এডিপির (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের খরচসহ) ৪৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচসহ চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপির আকার ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। সম্প্রতি এডিপির আকার কমিয়ে ২ লাখ ১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। মূল এডিপির সংশোধিত আকার হলো ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। কিন্তু সেই সংশোধিত এডিপিও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও ৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের বরাদ্দের ২০ শতাংশও খরচ করতে পারেনি। এই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো আইন ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়।

এমন বেহাল উন্নয়ন প্রকল্পের পরও আগামী অর্থবছরে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার মূল এডিপি নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরও ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এডিপির আকার দাঁড়াল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। দেড় হাজারের বেশি প্রকল্পে এই বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা খরচে সক্ষমতার অভাব আছে। তাই বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলেও অর্থ ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা হয় না। আর এডিপির মাধ্যমে সরকার যে উন্নয়ন বরাদ্দ করে থাকে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অনেকেরই তা খরচের সামর্থ্য নেই। এবার যোগ হয়েছে করোনা। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।