কালোটাকা সাদা
দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়।
এ পর্যন্ত ১৭ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, কিছু লোক সুযোগটি নিয়েছেন। গত ১ জুলাই অর্থবছর শুরু হওয়ার পর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৫৮ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, ফ্ল্যাট ও জমি কিনে কালোটাকা সাদা করেছেন ৩ হাজার ২২০ জন। সরকার এ থেকে কর পেয়েছে ৩৮১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। আর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করেছেন ১৩৮ জন। তাঁদের কাছ থেকে সরকার কর পেয়েছে ১৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তাঁদের সবাই রিটার্ন দাখিল করে অপ্রদর্শিত আয়ের ঘোষণা দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেট বক্তব্যে বলেছিলেন, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, একই সময় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে, আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না। এর বাইরে বিনিয়োগ চাঙা করতে বিদায়ী অর্থবছর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে সরকার। সেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কর দিলেই এখন প্রশ্ন করবে না এনবিআর। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সুযোগ আছে।
এখন পর্যন্ত কেউ হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করেননি বলে জানা গেছে। বিদায়ী অর্থবছরে ফ্ল্যাট কেনায়ও তেমন সাড়া পায়নি সরকার। এই সংখ্যা ছিল এক শর মতো।
এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে যে পরিমাণ কালোটাকার মালিক আছেন বলে অনুমান করা যায়, সে তুলনায় পাঁচ মাসের চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। ভবিষ্যতে তথ্য গোপনীয় থাকবে না—এমন আশঙ্কা থেকেও অনেকে সাদা করতে যান না। আর রাঘববোয়ালেরা বিদেশে পাচার করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উচিত হবে চাঁদাবাজি, ঘুষের মতো কালোটাকার উৎসমুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া।
তবে দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। খুব বেশি সাড়া না মেলায় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘নানা কারণে অনেকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেননি বলে আবেদন-নিবেদন বিবেচনা করে সরকার তাঁদের কর-অনারোপিত প্রকৃত আয়ের ঘোষণার জন্য এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত আর একবার সুযোগ দিয়েছেন। আশা করা যায়, করদাতারা তাঁদের এখনো অপ্রকাশিত আয় ঘোষণার এই শেষ সুযোগ হারাবেন না। কেননা, এরপর কর ফাঁকির মামলাসমূহের ব্যাপারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ জিয়াউর রহমানের সময় মাত্র ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সরকার ৫ মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে। আগেরবারের তুলনায় কালোটাকা সাদা করার প্রবণতা বাড়ছে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি করে লে. জেনারেল এরশাদ সামরিক আইনের ৫ নম্বর ধারায় ১৫ শতাংশ কর দিয়ে আবারও একই সুযোগ দেন। শুরুতে নিয়মকানুন কঠোর হলেও পরে তা অনেক সহজ করা হয়। তার পরও এরশাদের সময় মাত্র ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল।
১৯৯১-৯২ অর্থবছরে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বাজেটে বলেছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কালোটাকা বৈধ করার যে ধরনের বৈষম্যমূলক কর দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি আমাদের এ গণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ পরিহার করবে।’ সে সময়ে ঘোষণা দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া প্রথমবারের মতো কর দিয়ে জমি-ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি কিনলে বিনা প্রশ্নে তা মেনে নেওয়ার বিধান করেন। শিল্প ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ তৈরি করেন তিনি। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের বাজেটে শাহ এ এম এস কিবরিয়াও স্বীকার করেন যে সুযোগ দিলেও এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি।
আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে অর্থমন্ত্রী হন এম সাইফুর রহমান। তিনি কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে বিপুল অঙ্কের কর অনারোপিত আয় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে একাধিকবার কর অনারোপিত আয় ঘোষণার বেলায় যে আংশিক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিনিয়োগের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায়নি।’
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়, এর মধ্যে সুযোগ না নিলে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগ নেয় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এতে বৈধ হয় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
২০০৯ সালে নতুন সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ আরও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। এমনকি আয়কর অধ্যাদেশে স্থায়ীভাবে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে কালোটাকা সাদা করার আইনি সুযোগ রাখা হয়। এই ধারাটি হচ্ছে ১৯ ই। এর ফলে প্রযোজ্য আয়করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিলে যে কেউ অর্থ সাদা করতে পারবেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার যে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা চিরতরে বন্ধ করা উচিত। ঢালাও সুযোগ দেওয়ার পরও যে পরিমাণ সাড়া পাওয়া গেছে, তা হতাশাজনক। আশা করি, সরকার তা অনুধাবন করবে।’