এই সময়ে ঋণ পরিশোধ না করলেও কেউ খেলাপি হবেন না, এমন সুযোগ থাকার পরও কৃষকেরা যথারীতি ঋণ শোধ করে যাচ্ছেন।
গত জুলাই-অক্টোবরে ৮,৪৫৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ শোধ করেছেন কৃষকেরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১,৬৯৯ কোটি টাকা বেশি।
চলতি অর্থবছরে ৫৯টি ব্যাংকের মোট কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২৬,২৯২ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর কৃষিঋণের সুদহার কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আবার কৃষকেরা নতুন করে রেয়াতি সুদও ঋণ পাচ্ছেন। এর সুফলও মিলছে। কৃষকেরা ঋণ শোধ করে যাচ্ছেন। যদিও এই সময়ে ঋণ পরিশোধ না করলেও কেউ খেলাপি হবেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার ঋণ শোধ করেছেন কৃষকেরা। এই অর্থ গত বছরের একই সময়ে কৃষকদের শোধ করা ৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার চেয়ে ১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা বেশি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী হোসেন প্রধানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রণোদনা ঋণের প্রায় পুরোটাই বিতরণ করেছি। কৃষকেরাও আগের মতোই ঋণ শোধ করে যাচ্ছেন। সময়টা কৃষি মৌসুম ছিল, এটাও ঋণ শোধের কারণ হতে পারে। আমরা ঋণ আদায়ে কোনো জোর করিনি, কৃষকেরা স্বপ্রণোদিত হয়েই ঋণ শোধ করছেন।’
আলী হোসেন প্রধানিয়া আরও বলেন, ‘আমরা একেবারে নতুন গ্রাহকদের প্রণোদনা ঋণ দিয়েছি। এটা কৃষি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। যেসব কৃষক ঋণ পেয়েছেন, তাঁদের অনেকে উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবেন।’
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দেশের ৫৯টি ব্যাংকের মোট কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিতরণ হয়েছে ৬ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ। গত অর্থবছরে বছরের একই সময়ে বিতরণ হয়েছিল ৬ হাজার ৫৪ কোটি টাকা, যা ওই বছরের লক্ষ্যমাত্রার ২৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত কৃষকেরা ঋণ শোধ করে থাকেন। ঋণের একটা অংশ বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে বিতরণ হয়। ব্যাংকগুলো ছাড় দিলেও তারা ঋণ আদায়ে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে ঋণ আদায় আগের চেয়ে বেড়েছে। অবশ্য ঋণ বিতরণের এই হিসাব প্রণোদনা ঋণের বাইরে। কৃষি খাতের সব ঋণের সুদ কমে যাওয়ায় ঋণ বিতরণ আগের চেয়ে বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শস্য খাতে ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। কৃষকদের সেচযন্ত্র কিনতে ৫৬ কোটি টাকা, কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে ৪২ কোটি টাকা, পশু–পাখি ও হাঁস–মুরগি পালনে ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, মৎস্য খাতে ৭২৪ কোটি টাকা, শস্য সংরক্ষণ ও বিপণনে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। দারিদ্র্য বিমোচন খাতে ঋণ গেছে ৫০৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাতে বিতরণ হয়েছে ৬৫৪ কোটি টাকা। অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে কৃষিঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাসের কারণে কৃষিঋণের সুদহার কমিয়ে ৪ শতাংশ করার পাশাপাশি কৃষকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি মূলধন পাবে মৌসুমভিত্তিক ফুল ও ফল চাষ, মাছ চাষ, পোলট্রি ও ডেইরি এবং প্রাণিসম্পদ খাত। কৃষক ছাড়াও যেসব উদ্যোক্তা কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বিক্রি করেন, তাঁরাও এই স্কিমের আওতায় ঋণ নিতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এককভাবে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে পারবে না।
এই ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়। ব্যাংক কৃষকদের দেয় সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে। এই ঋণ সর্বোচ্চ দেড় বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। প্রথম ছয় মাস ঋণ পরিশোধে ছাড় রয়েছে। তবে পরের ১২ মাসে তা শোধ করতে হবে।
এই ঋণের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) ৩১৯ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্য দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির তা পুরোটাই বিতরণ করলে লক্ষ্য বাড়িয়ে ৪১৬ কোটি টাকা করা হয়।
রাকাবের এমডি এ কে এম সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকেরা দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা ঋণ পান, তাঁরা শোধ করেন। এই সময়ে যাঁরা ঋণ পেয়েছেন, তাঁরা নতুন করে কৃষিতে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁরা নিয়মিত ঋণ শোধও করছেন।