ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) এখন যেমন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার বা ঋণপত্র কেনাবেচা হয়, তেমনই একটি এক্সচেঞ্জে কেনাবেচা হবে আলু-পটল, ধান-চাল ও পাটের মতো পণ্য। একই সঙ্গে এতে হাজার হাজার ক্রেতা-বিক্রেতা অংশ নিতে পারবে। চালুর অপেক্ষায় থাকা সেই এক্সচেঞ্জটির নাম ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’।প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বা পণ্য বিনিময় কেন্দ্র চালু থাকলেও বাংলাদেশের কার্যক্রম এখনো কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই আটকে রয়েছে। তিন বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) আওতায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। পরে কাজটি আর এগোয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার চার মাসের মাথায় বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর ব্যাপারে আবারও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হয়। এরপর আট মাস পেরিয়ে গেলেও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ হয়নি। কিংবা এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির ষষ্ঠ বৈঠকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠন সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য জাপানের শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের কার্যক্রম পরিদর্শন এবং সেই আলোকে এ দেশে পণ্যসামগ্রীর ভবিষ্যত্ বাজার খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।পরে এসইসির তত্কালীন চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ওই কমিটিকে জানান, শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি। তবে মুম্বাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কমিটির সিদ্ধান্তমতে, শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে এসইসি থেকে দুজন প্রতিনিধির মুম্বাই যাওয়ার কথা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের গড়িমসির কারণে শেষ পর্যন্ত কেউই যেতে পারেননি বলে জানা গেছে। শুরুর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও বিষয়টি বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য স্বীকার করেন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠন এখন সময়ের দাবি। আর কমোডিটি এক্সচেঞ্জ স্থাপনে বিনিয়োগ করতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বলে জানা যায়। কৃষি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত আছে, এমন একাধিক বড় প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে ভাবছে। এমনকি পুঁজিবাজারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত একাধিক প্রতিষ্ঠানও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দুবাই কমোডিটি এক্সচেঞ্জের অর্থায়ন সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানেরও বিনিয়োগের আগ্রহের বিষয়টি জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে সিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ালি-উল-মারূফ মতিন প্রথম আলোকে বলেন, এই এক্সচেঞ্জ চালু হলে কৃষকের পক্ষে ন্যায্যমূল্য পাওয়া সহজ হবে। এটি সরকারের কাজ সহজ করবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে কারসাজি অনেক কমে যাবে। কৃষকেরাও আগাম পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। আর তাই এটি দ্রুত চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।আগের কথা: ওয়ালি-উল-মারূফ মতিন ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব পেশ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাণিজ্য উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এ ব্যাপারে সক্রিয় হন। তাঁর নেতৃত্বেই পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল ২০০৮ সালের মার্চে মুম্বাই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পরিদর্শন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্কালীন যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আলী পাটোয়ারীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের আরেকটি দল পরিদর্শন করে ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ (এমসিএক্স)। উভয় দল আলাদাভাবে প্রতিবেদন দাখিল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চকে (বিইআর) আরও গবেষণা করে একটি খসড়া তৈরি করতে বলা হয়। উল্লিখিত দুই পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা সম্পৃক্ত করে একটি খসড়া তৈরি করে বিইআর। ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর এর ওপর একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালা শেষে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে এও বলা হয়, প্রাথমিক অবস্থায় এর নিয়ন্ত্রক থাকবে এসইসি। বিইআরের খসড়ায় ধান, পাট, আলু, পাট, চা, চিনি, স্বর্ণ ও রৌপ্যকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের আওতায় আনার কথা বলা হলেও প্রাথমিকভাবে আলু ও পাট নিয়ে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শুরুর সুপারিশ করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, এই পণ্য দুটি তুলনামূলকভাবে কম মূল্য স্পর্শকাতর। তদারকির জন্য এসইসিতে একটি বিশেষ বিভাগ খোলারও সুপারিশ করে বিইআর। তবে বাজার বড় হলে ধীরে ধীরে এসইসি থেকে সরিয়ে আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের পক্ষে মত দেওয়া হয়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে প্রতিবেদনে সচেতনতার অভাবকে প্রধান বাধা রূপে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে তা চালু করার ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থাকলেও সুবিধার দিকই বেশি।পণ্য বিনিময় কেন্দ্রে অনেকটা শেয়ারবাজারের মতো বিভিন্ন পণ্য আগাম ভিত্তিতে বেচাকেনা হবে। বিশ্ব পরিস্থিতি: জানা যায়, উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও শতাধিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ রয়েছে। ২৮টি রয়েছে লাতিন আমেরিকায়, যার মধ্যে শুধু ব্রাজিলেই রয়েছে ১৫টি এক্সচেঞ্জ। এ ছাড়া এশিয়ায় ২০টি, আফ্রিকায় তিনটি, পূর্ব ইউরোপে চারটি এবং রাশিয়ায়ও কয়েকটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ রয়েছে। এদের বেশির ভাগই গঠিত হয়েছে ১৯৯২ সালের পর। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এ জাতীয় এক্সচেঞ্জ রয়েছে। তবে লেনদেন ও চুক্তির পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম সারির ২২টি এক্সচেঞ্জের মধ্যে নয়টিরই অবস্থান উন্নয়নশীল দেশে। এদের বেশির ভাগই গঠিত হয় আশি এবং নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে। বিশ্বের শীর্ষ ১০ কমোডিটি এক্সচেঞ্জের তালিকায় ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নাম রয়েছে।