আগে থেকে হোটেল ঠিক না করে বেড়াতে আসায় কক্সবাজারে থাকার জায়গা পাচ্ছেন না পর্যটকেরা। হোটেল-মোটেল-কটেজে জায়গা না পেয়ে হাজারো পর্যটক সৈকতের বালুচরে পায়চারি করে অথবা বিভিন্ন স্থানে রাত কাটাচ্ছেন।
হোটেল মালিক ও টুরিস্ট পুলিশের ভাষ্যমতে, গত তিন দিনে অন্তত সাড়ে ৪ লাখ পর্যটক সৈকত ভ্রমণে এসেছেন। এ সময় ব্যবসা হয়েছে শত কোটি টাকার।
আজ শনিবার সকালে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে নেমে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক পর্যটক গোসলে ব্যস্ত। অন্যদিকে হোটেল না পেয়ে শহরের কলাতলী সড়কে দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য পর্যটক। তাঁদের সঙ্গে শিশুরাও। জীবনের প্রথম বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে এসে দুর্ভোগে পড়তে হবে, তা তাঁদের জানা ছিল না।
চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সকালে কলাতলী হাঙর ভাস্কর্য মোড়ে নামেন রাজশাহী থেকে আসা ব্যবসায়ী নবাব মিয়া (৪৫)। এরপর আশপাশের ১০-১২টি হোটেলে খোঁজ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোথাও কক্ষ ভাড়া পাওয়া যায়নি। দুপুর ১২টার দিকে নবাব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত লোক এখানে আসবে, কল্পনাও করিনি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় যাব, ভেবে পাচ্ছি না।’
শহরের সুগন্ধা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মোড়েও হোটেলের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা গেছে শতাধিক পর্যটককে। এর মধ্যে নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ চরমে।
আগের দিন হোটেলে কক্ষ না পেয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে সঙ্গে আনা বাস, বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার টিকিট কাউন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খাবারের রেস্তোরাঁ, সৈকতের বালুচরে বসার চেয়ার, হোটেলের অভ্যর্থনাকক্ষ এবং স্থানীয় লোকজনের বাসাবাড়িতে থেকে সময় পার করতে হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লোকজনের এই সমাগম লেগে থাকবে বলে ধারণা হোটেলমালিকদের ।
১১৭টি কটেজ ও গেস্টহাউস নিয়ে গঠিত কক্সবাজার কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি কাজী রাসেল আহম্মেদ বলেন, গত এক যুগে এত বিপুল পর্যটকের সমাগম কক্সবাজারে হয়নি। গত তিন দিনে সৈকত ভ্রমণে এসেছেন ৪ লাখ ৭০ হাজারের মতো মানুষ। শনিবার কক্সবাজারে অবস্থান করেন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ। চার শতাধিক হোটেল-মোটেল-কটেজের কক্ষ অগ্রিম বুকিং থাকায় অনেকে বিপাকে পড়েছেন।
হোটেলমালিকেরা বলেন, শহরের ৪০ থেকে ৫০টি উন্নতমানের হোটেল-মোটেলের অধিকাংশ কক্ষ দেড় বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের দখলে থাকায় বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমস্যায় পড়েছেন। ভবিষ্যতেও এ সংকট থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে অগ্রিম হোটেলকক্ষ বুকিং দিয়েই ভ্রমণে আসা উচিত।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, হঠাৎ করে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি পর্যটকেরা দলে দলে পাহাড়ি ঝরনার হিমছড়ি, দরিয়ানগর, পাথুরে সৈকত ইনানী, টেকনাফের মাথিন কূপ, নাফ নদী, মেরিন ড্রাইভ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যাচ্ছেন। সেখানেও তিল ধারণের জায়গা নেই। কঠোর নিরাপত্তার কারণে কেউ কোনো সমস্যায় পড়েননি। তবে পর্যটকেরা হোটেল ভাড়া অতিরিক্ত হারে আদায়ের অভিযোগ করেন।
এ প্রসঙ্গে কাজী রাসেল আহম্মেদ বলেন, সৈকত এলাকার কিছু হোটেলে কক্ষের ভাড়া অতিরিক্ত হারে আদায়ের অভিযোগ আসছে। কিন্তু তা দেখার এখতিয়ার তাঁর নেই।
পর্যটকেরা অভিযোগ করেন, কয়েক হাজার পর্যটক বাসে কিংবা সৈকতে পায়চারি করে রাত পার করলেও তাঁদের গোসল ও পয়োব্যবস্থা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের এই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বেশি। সৈকতের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট ছাড়া শহরের অন্য কোথাও শৌচাগার কিংবা চেঞ্জিং রুম নেই।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ জয় বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা গত দুই দিনে হোটেল কক্ষ না পাওয়া কয়েক শ পর্যটককে মানবিক সহযোগিতা দিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার কল্যাণপুর ও মিরপুর থেকে আসা ৫০ জনের একটি দলকে বিমানবন্দর সড়কের একটি ফ্ল্যাট বাসায় এবং ২০ জনের আরেকটি দলকে শহরের ঝাউতলার একটি অডিটোরিয়ামে রাত যাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এনজিও কর্মকর্তারা বলেন, হোটেল-মোটেলগুলোতে অফিস আর মাসিক ভিত্তিতে রুম নিয়ে নেওয়ায় পর্যটকদের এ সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, গত তিন দিনে চার লাখের বেশি পর্যটক কক্সবাজারে এসেছেন। এর বিপরীতে ব্যবসা হয়েছে শত কোটি টাকার। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরও তিন-চার লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসার সম্ভাবনা আছে। তখন আরও শত কোটি টাকার ব্যবসা হবে।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাঁদের সমস্যা সম্পর্কে সজাগ আছে প্রশাসন। পর্যটকদের কাছ থেকে হোটেলের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে আছে। পর্যটক হয়রানির যেকোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।