করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পণ্য রপ্তানি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। গত মার্চে ২৭৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির পর গত মাসেই তলানীতে ঠেকেছে রপ্তানি বাণিজ্য। সবমিলিয়ে এপ্রিলে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি বা ৪ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের পণ্য, যা গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম।
করোনার কারণে গত মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের চেয়ে অর্ধেকের কম হয়েছে পণ্য রপ্তানি আয়। গত এপ্রিলে ১০৮ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। গত বছরের এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৪৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়। সেই হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুই খাতই বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিয়েছে মরণঘাতী ভাইরাস।
এপ্রিলের বির্পযয়ের কারণে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি কম গেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ কম।
রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ পরিসংখ্যান সম্প্রতি প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারো (ইপিবি)। তাদের তথ্যানুযায়ী, পাট ও পাটজাত পণ্য ছাড়া অন্য প্রায় সব খাতের রপ্তানি আয় গেছে। তার মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ২ হাজার ৪৪৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বেশ খারাপ। গত মাসে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে প্রায় ৮৪ শতাংশ কম।
এক মাসে এতো কম পোশাক রপ্তানি শেষ কবে হয়েছিল সেটি মনে করতে পারেননি নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। তিনি আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই-তিন দশকে এক মাসে এতো কম পোশাক রপ্তানি কখনই হয়নি। তবে করোনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এপ্রিলে পোশাক রপ্তানি কম হবে সেটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে মে ও জুন মাসে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪১ কোটি ডলারের হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। এ ছাড়া আলোচ্যসময়ে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৭৫ কোটি ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। প্রথম দশ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।
শীর্ষ খাতগুলোর মধ্যে একমাত্র পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৭৯ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ কম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছর ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সেটি অর্জন করতে হলে শেষ দুই মাসে ১ হাজার ৬০১ কোটি ডলারের রপ্তানি করতে হবে। তার মানে প্রতি মাসে গড়ে ৮০০ কোটি ডলারের রপ্তানির প্রয়োজন। তবে চলতি অর্থবছরের কোনো মাসেই রপ্তানি সেটির ধারে কাছেও যায়নি। ফলে চলতি অর্থবছর রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে পণ্য রপ্তানিতে ধাক্কা আসবে সেটি আগে থেকে ইঙ্গিত ছিল। কারণ পোশাকের অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। তা ছাড়া গত মাসে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় বন্ধই ছিল। অন্যদিকে প্রবাসী শ্রমিকেরা যেসব দেশে কাজ করেন সেখানেও অর্থনৈতি কর্মকান্ড খুব একটা নেই। সে জন্য প্রবাসী আয়ও কমে গেছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের পণ্য রপ্তানি বড় গন্তব্য দেশগুলো করোনায় বিপর্যস্ত হয়েছে বেশি। সেসব দেশে কাজ বন্ধ। কাজে ফেরার বিষয়টি শ্লথ হবে। ফলে পণ্য রপ্তানির বর্তমান সংকট থেকে উত্তোরণ সহজ হবে না। তবে স্বল্পমূল্যের পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। অন্যদিকে তেলের দাম কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি সংকটে পড়েছে। করোনার সময় অনেক শ্রমিক ফেরত পাঠাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে সেটি আরও বাড়তে পারে। ফলে প্রবাসী আয় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সিপিডির এই গবেষক বলেন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে গেলেও আপতত ব্যালেন্স অব পেমেন্টে সমস্যা হবে না। কারণ রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও কমে গেছে। তবে আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি না পেলে অর্থনীতি চাপে পড়তে পারে।