বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পাঁচ বছর হয়ে গেল। অথচ চুরি হওয়া অর্থের ৫৬১ কোটি টাকা এখনো ফেরত আসেনি। এমনকি অর্থ ফেরত দেওয়ার আশ্বাসও মেলেনি। রিজার্ভ চুরি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে যে মামলা করেছিল, তা–ও টেকেনি। অর্থ ফেরত ও জড়িতদের শাস্তির জন্য এখন নতুন করে স্টেট কোর্টে মামলা করেছে। এখনো সেই মামলার শুনানি শুরু হয়নি। ফলে অর্থ ফেরত পাওয়ার আশার আলো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশেও কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন কোনো ধরনের সতর্কতা পেলেই বিভিন্ন নেটওয়ার্কে কড়া তদারকি ব্যবস্থা নিচ্ছে। এমনকি কর্মকর্তাদের কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখছে। আর ব্যাংকগুলোকেও সময় সময় সতর্ক করার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে বলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক বা নিউইয়র্ক ফেডে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা চুরি হয় ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ফেরত আসে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এখনো চুরি হওয়া অর্থের ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৬১ কোটি টাকা উদ্ধার হয়নি।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অরক্ষিত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দায়িত্বহীন। আর চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটানো হয় আন্তর্জাতিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় লেনদেনের নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে।
রিজার্ভ চুরির তিন বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা করে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি দায়ের করা মামলায় ফিলিপাইনের পাঁচটি আর্থিক ও ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠান, দেশটির ১২ জন, ৩ জন চীনা নাগরিকসহ মোট ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই আদালতে সব পক্ষ প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দেয়। ২০২০ সালের ২০ মার্চ আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে মামলাটি করা হয়েছে, তা ওই আদালতের এখতিয়ারাধীন না। তবে স্টেট আদালতে মামলা চলতে পারে বলে মত দেন ফেডারেল আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মামলায় একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মামলার বিষয়ে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অর্থ উদ্ধারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউনিট প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্টেট কোর্টে মামলা চলছে। আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই শুনানি হবে।’ অর্থ ফেরত পেতে আর কোনো প্রক্রিয়া চলছে কি না, জানতে চাইলে রাজী হাসান বলেন, ‘অন্য সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই মামলা হয়েছে। এখন মামলার মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।’ ফলে টাকা উদ্ধারে এখন আদালতের ওপর ভরসা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মধ্যে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার নিয়ে ফিলিপাইনের আদালতে কমপক্ষে ১২টি মামলা চলমান। এর মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থ জব্দও করে রেখেছেন দেশটির আদালত। তবে এসব মামলার অগ্রগতি খুবই মন্থর। ফলে ফিলিপাইনের মামলার মাধ্যমে টাকা আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ নিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে হবে, এটাই এখন একমাত্র পথ।