একটি কলা, একটি রুটি এখন আরও দামি

বাজারে এখন কলার দাম বেশি। রুটি-বিস্কুটের দাম আগেই বেড়েছে। আরও বাড়বে, জানালেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে রুটি ও কলা খাচ্ছিলেন রিকশাচালক আমজাদ হোসেন। তিনি জানালেন, সকালে নাশতা খেয়ে রিকশা নিয়ে বের হওয়ার পর দুপুরে ভাত খাওয়ার আগে অন্তত একবার রুটি-কলা খেতে হয়। নইলে রিকশা চালানোর মতো পরিশ্রমের কাজ করা যায় না।

আমজাদ হোসেনের হাতে ছিল মোটামুটি বড় আকারের একটি সবরি কলা। মৌসুমের এই সময়টায় বাজারে এই কলার সরবরাহ বেশি থাকে। চায়ের দোকানি আমজাদের কাছ থেকে কলাটির দাম রেখেছেন ১৫ টাকা। আর বানরুটির দাম ১০ টাকা।

আমজাদ হোসেনের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। এক যুগ ধরে তিনি রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, বছর দুয়েক আগে একটি বানরুটির দাম ছিল ৭ টাকার মতো। বড় কলা কেনা যেত ৮ টাকায়। ফলে রুটি-কলা খেতে তাঁর ব্যয় ছিল ১৫ টাকা। সঙ্গে ৫ টাকায় এক কাপ চা-ও পান করতেন তিনি। মোট ব্যয় ছিল ২০ টাকা। এখন কলা-রুটিতে লাগে ২৫ টাকা আর চা ৫ টাকা—মোট ৩০ টাকা লাগে।

পাউরুটি

ঢাকার চায়ের দোকানে যে রুটি-বিস্কুট বিক্রি হয়, তার দাম আগেই বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে বেড়েছে কলার দামও। ফলের খুচরা দোকান ও আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি ডজনে (১২টি) কলার দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ৩০ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, যাঁদের দিনে কয়েকবার একটি রুটি, একটি কলা খেতে হয়। সীমিত আয়ের অনেক মানুষ এখন দুপুরে রেস্তোরাঁয় বাড়তি ব্যয়ে খাওয়ার বদলে রুটি-কলা খেয়ে কাটান।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সবজির আড়তের সামনের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে গতকাল এক ডজন বড় সবরি ও নরসিংদীর সাগর কলা ১২০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায় বিক্রেতাদের। যা এক সপ্তাহ আগেও ৯০ টাকার আশপাশে ছিল বলে দাবি তাঁদের। আর ভালো মানের চাঁপা কলা বিক্রি করতে দেখা যায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা ডজন দরে, যা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল। মাঝারি ও ছোট কলার দাম আরেকটু কম। যেমন ছোট চাঁপা কলা ৫০ টাকা ডজনেও বিক্রি হচ্ছিল।

ঢাকার হাতিরপুল ও তেজতুরী বাজার এবং কাঁটাবন, পান্থপথ, ফার্মগেট ও তেজগাঁওয়ের কয়েকটি ফলের দোকান ও চায়ের দোকান ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কলার দাম আরও বেশি।

তেজতুরী বাজারের শহীদুল ইসলাম নামের এক ফল বিক্রেতার দোকানে প্রতি ডজন বড় সবরি কলা ১৫০ টাকা ও চাঁপা কলা ৭৫ টাকা চাওয়া হচ্ছিল। এই বিক্রেতা প্রথম আলোকে বলেন, আড়তেই কলার দাম বেশি।

কারওয়ান বাজারের উত্তর পাশে ফলের আড়ত। সেখানকার স্বপন মিয়ার আড়তে গিয়ে দেখা গেল, শত শত কলার কাঁদি। বিক্রেতারা জানান, আড়তে গতকাল আকারভেদে প্রতি পণ (৮০টি) সবরি কলা ৫০০ থেকে ৬৫০, সাগর কলা ৭০০ থেকে ৮০০ ও চাঁপা কলা ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। তার মানে হলো, আড়তে একটি বড় সবরি কলার দাম ৮ টাকার বেশি পড়ছে। বড় একটি সাগর কলার দাম পড়ছে ১০ টাকা।

স্বপন মিয়ার আড়তে ছিলেন কলার ফড়িয়া ব্যবসায়ী বাচ্চু মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দাম বাড়ার কারণ সরবরাহ কম। পবিত্র রমজান মাসে দাম বেশি পাওয়ার আশায় চাষিরা অপরিপক্ব কলাও বিক্রি করে দেন। এখন কলা পাওয়া যাচ্ছে না।

বাচ্চু মিয়া আরও উল্লেখ করেন, কয়েক মাস ধরেই কলার দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর কারণ ট্রাকভাড়া বেড়েছে। মেহেরপুর থেকে ঢাকায় কলা নিয়ে আসতে একটি পিকআপের ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার টাকা, যা গত নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে ১৩ হাজার টাকা ছিল।

যা-ই হোক, চায়ের দোকানিরা বলছেন, কলা-রুটির বিক্রি আগের চেয়ে কিছুটা হলেও কমেছে। যে রিকশাচালক বা শ্রমজীবী মানুষ দিনে তিনবার কলা-রুটি খেতেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন দুবার খাচ্ছেন।

ঢাকার পান্থপথের সালাম টি স্টলের বিক্রেতা রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রুটি-কলার দাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের লাভের অঙ্ক কমেছে। সঙ্গে কমেছে বেচাকেনা।’

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় ২০১৯ সালে এক হালি সবরি কলার গড় দাম ছিল সাড়ে ৩৪ টাকা। ২০২১ সালে তা প্রায় ৪০ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায়। মানে হলো, সহজপ্রাপ্য এই ফলের গড় দাম তিন বছরে ১৭ শতাংশ বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বানরুটির দাম বাড়ার কারণ ময়দা, ভোজ্যতেল ও সমজাতীয় পণ্য, চিনিসহ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক বছর আগের তুলনায় এখন ময়দার দাম ৭২ শতাংশ, খোলা পাম তেল ৫৯ শতাংশ ও চিনির দাম ৮ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ রুটি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় ছোট বেকারিগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। আর বিপাকে পড়েছেন রিকশাচালক, দিনমজুর, শ্রমিক ও আর্থিকভাবে চাপে থাকা মানুষেরা। তিনি বলেন, উপকরণের দাম এতটা বেড়েছে যে সারা দেশে আবারও রুটি-বিস্কুটের দাম বাড়বে, যা কার্যকর হবে ১ জুন থেকে।