>উন্নত হলে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়, না কমে—এই আলোচনা এবার উঠল বাংলাদেশেই। এবারের সিটি নির্বাচনে ভোটার ছিল অনেক কম। দেখা যাক গবেষণায় কী বলে—
এটা আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে উন্নয়ন ও উন্নয়নের মাত্রার আর্থসামাজিক প্রভাব বেশ ব্যাপক। উন্নয়নের প্রভাব যেমন রয়েছে মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার ওপরে, তেমনি রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার ওপর।
কয়েক বছর আগে শিকাগো পলিসি রিভিউতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, একটা দেশের ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির সংখ্যা নির্ভর করে সে দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন ধাপে রয়েছে, তার ওপর। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশে ভোটারের উপস্থিতি উন্নত দেশের ভোটার উপস্থিতির চেয়ে কম। অন্যভাবে বললে, একটা দেশ যখন আস্তে আস্তে উন্নয়নের শিখরে যাবে, সে দেশের নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বাড়বে।
কেন অনুন্নত দেশে ভোটারের উপস্থিতি কম থাকার কথা? এটা ধরে নেওয়া হয় যে অনুন্নত দেশের নাগরিকেরা কম শিক্ষিত হয়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং বেশি মাত্রায় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আদর্শ ও বিশ্বাস ধারণ করে। এটা খুবই সম্ভব যে নিম্ন আয়ের দেশে আয়, শিক্ষা ও কৃষ্টির মানের ভিন্নতা মানুষের মধ্যে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী গতিশীলতা নিয়ে আসে, যার প্রভাব পড়ে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির ওপর।
আবার উন্নত দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে ভোট প্রধান করা সম্ভব, যাতে ভোটের সংখ্যা বাড়ে। যেমন অনেক উন্নত দেশে চিঠি, ই–মেইলের মাধ্যমে বা অগ্রিম ও প্রক্সি ভোট দেওয়ার নিয়ম আছে, যা কিনা ভোটারের সংখ্যা বাড়াতে সহায়তা করে।
কিন্তু একই গবেষণায় দেখা গেছে যে উন্নয়ন কিংবা সম্পদ অর্জনের একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর ভোটারের উপস্থিতি আবার কমতে থাকে। এটা কেন হয়, তারও একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন একটা দেশ যখন অনেক উন্নত হয়ে যায়, তখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। এর ফলে তারা আর্থসামাজিক বিষয়গুলো, যেমন মানবাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে। ফলে ভোটাররা গতানুগতিক নির্বাচনী ধারাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
বিভিন্ন দেশের শহর ও গ্রামে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতির পরিসংখ্যান বলে যে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ ভোটে কিছুটা কম অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এটা যে শুধু আয়ের ওপর নির্ভর করে, তা নয়। বরং শহরে অনেক সময় আয়বৈষম্য গ্রামের চেয়ে বেশি থাকে, তার প্রভাবও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির ওপর পড়তে পারে।
তার মানে, উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের প্রভাব কীভাবে ভোটার উপস্থিতির ওপরে পড়ে, সেটাও লক্ষ করা দরকার।
আয়ের বৈষম্যও ভোটারের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতিকে প্রভাবিত করে। অনেক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে উন্নত বিশ্বে আয়বৈষম্য বাড়লে ভোটারের উপস্থিতি কমে। যখন আয়বৈষম্য বেশি থাকে, তখন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে নির্বাচনী ধারায় অংশগ্রহণ করার মতো যৌক্তিক স্বার্থ থাকে না। তার মানে দাঁড়ায়, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ধারায় অংশগ্রহণ করার জন্য আসলে একধরনের আর্থিক সংগতির প্রয়োজন হয়, যা কিনা আয়বৈষম্য বেশি থাকা একটা সমাজে কম থাকার কথা।
একই কারণে বলা যায়, কোনো দেশে যদি আয়ের বৈষম্য বাড়তে থাকে, সে দেশে আস্তে আস্তে ভোটারের উপস্থিতি কমে যাবে। এটা যে শুধুমাত্র নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য হবে, তা নয়, বরং সমাজের প্রতিটা আয়–শ্রেণির মানুষের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে অনীহা দেখা যাবে। যেমন যখন আয়বৈষম্য বেশি থাকবে, তখন গরিব জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের প্রতিনিধিহীন ও রাজনৈতিকভাবে মোহমুক্ত ভাবা শুরু করবে। আবার ধনী জনগোষ্ঠী নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ধারাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবে এই ভেবে যে তাতে যদি আবার তাদের অর্জিত সম্পদ পুনঃবণ্টনের প্রয়োজন হয়। সাধারণত আয়বৈষম্য সামাজিক সংযোগ দুর্বল করে ফেলে, তার ফলেও ভোটাররা ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
বিপরীতভাবে আয় বাড়তে থাকলে ভোট দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এটা যেমন ব্যক্তিপর্যায়ে হয়, তেমনি জাতীয় পর্যায়েও হবে। গবেষণায় বলে, জনপ্রতি জিডিপি বাড়লে ভোটারদের মধ্যে ভোট প্রদানের প্রবণতা বাড়ে। তেমনিভাবে বেকারত্ব বাড়তে থাকলে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন।
গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, যে দেশে ‘সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা’ এবং ‘দুর্নীতি’ করার চর্চা বেশি দেখা যায়, সে দেশে ভোটারের উপস্থিতি কম থাকে। এটা উঁচু মানের গণতান্ত্রিক দেশেও হতে পারে। এটা ধরে নেওয়া হয় যে, যে সমাজে ‘সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা’ করার চর্চা বেশি থাকে, সে সমাজে দুর্নীতিও বেশি হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে আয়বৈষম্য বাড়ে, যার ফলে মানুষ নির্বাচনের প্রতি অনাগ্রহ হয়ে পড়ে।
গোলাম মোর্তজা, অর্থনীতিবিদ