বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে প্রায় ছয় মাস বেকার ছিলেন উদ্যোক্তা মুহাম্মদ মনির হোসেন। বেকারত্বের বদনাম গুছাতে একসময় রাজধানীর মতিঝিলে ভ্যানে করে আনারস বিক্রির চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি আর সম্ভব হয়নি। এরপর ফ্রিল্যান্সিং পেশায় যুক্ত হন মনির। প্রতিষ্ঠা করেন বিডিকলিং আইটি লিমিটেড নামে একটি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি।
মতিঝিলের ভাড়া বাসার ছোট্ট এক কক্ষে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন মনির হোসেন। বর্তমানে রাজধানীর বনশ্রীতে চারটি কার্যালয় নিয়ে চলছে এর কার্যক্রম। আর প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন চার শতাধিক কর্মী। তবে এই পর্যায়ে আসতে তাঁকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে।
মুহাম্মদ মনির হোসেনের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায়। বাবা পেশায় কৃষক। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মাধ্যমিক পাস করেন মনির। এরপর ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটারপ্রযুক্তিতে ডিপ্লোমা করেন। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় মনিরের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন তাঁর এক চাচা।
আর্থিক অনটনের কারণে ডিপ্লোমা শেষে চাকরি করাই ছিল মনিরের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু ২০০০ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার টেকনোলজিতে প্রথম হন। এরপর উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ বেড়ে যায় তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করা ও ভর্তি ফি জোগানোর মতো অর্থ তাঁর ছিল না। চাচাও আর সহযোগিতা করার পর্যায়ে ছিলেন না। তখন মনিরের বাবা জমি বিক্রি করে ছেলের হাতে ৪০ হাজার টাকা তুলে দেন। এই টাকায় কোচিং শেষে গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ভর্তি হন মনির।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। নিজের খরচ জোগাতে এ সময় কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন মনির। একবার রাজনৈতিক সংঘাতের জেরে সাময়িকভাবে ডুয়েট বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় কোচিং বন্ধ থাকায় নিজের খরচ জোগাতে গাজীপুর থেকে ঢাকার কলাবাগানে এসে টিউশনিও করেছিলেন তিনি।
স্নাতক পাসের পর ২০০৬ সালে ঢাকার মিরপুরে চলে আসেন মনির। তখন কয়েক মাস একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেছেন। ২০০৭ সালের শুরুর দিকে টেলিকম খাতের একটি সাব-কন্ট্রাকটিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। তবে শুরুতেই হোঁচট খান। ঠিকভাবে মজুরি না দেওয়ায় চাকরিটা ছেড়ে দেন। এর মাস তিনেক পরে একই ধরনের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন।
পরের বছর জাপানি বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি এনইসি করপোরেশনে কাজ করার সুযোগ পান মনির, সেখানে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। তবে পারিবারিক এক জটিলতায় হঠাৎ সেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে হয়। চাকরি হারিয়ে প্রায় ছয় মাস বেকার ছিলেন।
বেকার হয়ে পড়ায় মনির বাসা ছেড়ে ওঠেন মতিঝিলে এক বন্ধুর মেসে। ওই বন্ধুও ছিলেন বেকার। প্রচণ্ড অর্থাভাবের ওই সময় দুই বন্ধুকে ধারদেনা করে চলতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসার চেষ্টা করেন। যেমন একবার মতিঝিলে ভ্যানে করে আনারস বিক্রির পরিকল্পনা করেন দুই বন্ধু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি আর হয়নি।
এনইসি করপোরেশনে কাজ করার সময় মনির হোসেনের এক সহকর্মী খণ্ডকালীন ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতেন। এতে ভালোই আয় হতো তাঁর। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে শেষে ফ্রিল্যান্সিং শুরুর চিন্তা করেন তিনি। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য তখন ল্যাপটপ কেনা বা ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার মতো অর্থই পকেটে ছিল না। তবে কম্পিউটার প্রকৌশলী মনির ছিলেন পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী। তাই দমে যাননি কিছুতেই।
মনির হোসেন বলেন, এক বন্ধুর কাছে থেকে ল্যাপটপ ধার করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শেখা শুরু করি। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে একটা প্রোফাইল দাঁড়িয়ে যায়। নতুন নতুন কাজের সঙ্গে আয়ও বাড়তে থাকে। চাপ বাড়ায় কিছু কাজ অন্যদের দিয়েও করিয়ে নিতেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে। এই সময় প্রতি মাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলার আয় করতেন তিনি।
ক্রমেই মনিরের কাজ বাড়তে থাকে। একা একা এসব কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে তাঁর জন্য। তাই নতুন প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিডিকলিং আইটি নামের প্রতিষ্ঠান। শুরুতে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ ও সাতজন কর্মী নিয়ে মতিঝিলে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শুরু হয় তাঁর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মনিরকে। মনিরের কাজে সহযোগী ছিলেন স্ত্রী সাবিনা আক্তারও, যিনি এখন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
২০২০ সালে করোনাকালে মতিঝিল থেকে বনশ্রীতে কার্যালয় স্থানান্তর করেন মনির হোসেন। বর্তমানে বনশ্রীতে চারটি পৃথক কার্যালয় রয়েছে বিডিকলিং আইটির। সব কার্যালয় মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছেন চার শতাধিক কর্মী। ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার তরুণকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ঠিক করেছেন মনির হোসেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করে বর্তমানে মাসে দুই লাখ মার্কিন ডলারের বেশি আয় করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। কর্মীদের প্রতি মাসে গড়ে এক কোটি টাকার বেশি বেতন দেন।
মনির হোসেন জানান, বিডিকলিং আইটি মূলত ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল অ্যাপস তৈরি, ভিজ্যুয়াল ও ক্রিয়েটিভ ডিজাইন, ডেটা এন্ট্রি এবং ডিজিটাল মার্কেটিং—এই খাতগুলোয় কাজ করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে রয়েছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিং খাতে বড় সম্ভাবনা রয়েছে। এটি অনেকটা সমুদ্রে মাছ ধরার মতো। তবে এ জন্য আগে প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও কাজের জায়গা চেনা।
মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের ১০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কিছু কোর্স নকশা করেছি। এগুলোর মাধ্যমে গত জুলাই মাস থেকে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আর নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মনির হোসেন জানান, তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি কৃষি, আবাসন ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।