এত ক্যাপ বা টুপি কারা কেনে? শুধু টুপি বিক্রি করে একটা ব্র্যান্ড গড়ে তোলা যায়? মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হেড গিয়ারের তিন উদ্যোক্তার মুখোমুখি হই। তাঁরা বললেন, তরুণ থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীরা এসব টুপি কিনছেন। দেশের ভেতরে অনলাইনে মাসে হেড গিয়ারের সাত হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার টুপি বিক্রি হয়। আগামী বছর সংখ্যাটি দ্বিগুণে নিয়ে যেতে চান প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা।
হেড গিয়ারের তিন উদ্যোক্তা ইকরামুল হক, মো. ইমরান হোসেন ও ইফতেখার আহমেদ এখন দেশের বাইরেও নিজেদের ব্র্যান্ডকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সেই প্রস্তুতি হিসেবে গত মাসে দুবাইয়ে জিটেক্স নামের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন তাঁরা। সেখানে ভালো সাড়াও পেয়েছেন। তারপরই দুবাই ও ভারতের বাজারে ব্র্যান্ডটির ব্যবসা সম্প্রসারণ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানালেন তরুণ এই উদ্যোক্তারা।
রাজধানীর বসুন্ধরায় গত মঙ্গলবার ভরদুপুরে হেড গিয়ারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পরিপাটি কর্মপরিবেশ। কয়েকজন তরুণ কর্মী কম্পিউটারে কাজ করছেন। ছোট্ট একটি কক্ষে বসেন তিন উদ্যোক্তা। আলাপচারিতায় হেড গিয়ারের শুরুর যাত্রা, বিপর্যয় ও তারপর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শোনান তাঁরা।
হেড গিয়ার নামের প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের মো. ইমরান। স্কুলে পড়া অবস্থায় বিয়েশাদির অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ৩৫০টি অনুষ্ঠান আয়োজনের পর ফেসবুকে টি-শার্ট ও হুডি বিক্রির ব্যবসায় নামেন। একপর্যায়ে মাথায় এল টুপির ব্যবসার কথা। খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন, দেশে টুপির কোনো ব্র্যান্ড নেই। টুপির বাজারে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল পণ্য ও স্টকলট পণ্যের ছড়াছড়ি।
তখন করোনার সময়। পাশের ঘরে ছোট ভাই ইফতেখার আহমেদ মুঠোফোনে ভিডিও গেমস খেলছিলেন। ইমরান ছোট ভাইকে ডেকে বললেন, ‘একটা ব্যবসা করব। তুই হেল্প করতে পারবি?’ ইফতেখার বললেন, ‘পারব না কেন।’ এভাবেই শুরু। ওই রাতেই দুই ভাই মিলে ব্র্যান্ডের নাম ঠিক করলেন। তারপর লোগো তৈরি করে ফেললেন। পরদিন ইমরান ১২ হাজার টাকা নিয়ে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার থেকে বেশ কিছু টুপি কিনে আনলেন।
ইমরান বললেন, ২০২১ সালের ১২ আগস্ট হেড গিয়ারের যাত্রা শুরু। ফেসবুকে নিজেদের ব্র্যান্ড নামে টুপি বিক্রি করা শুরু করলাম। শুরু থেকেই আমরা একটা ব্র্যান্ড তৈরির চেষ্টা করতে থাকলাম। ফলে ক্রেতা আকর্ষণ ও সন্তুষ্টিতে আমাদের বিশেষ নজর ছিল। এভাবে দুই সপ্তাহের মধ্যে ৫২ হাজার টাকার টুপি বিক্রি করলাম। এভাবে হেড গিয়ারের ব্যবসা বাড়তে থাকল।
সরবরাহকারীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। তৃতীয় দফায় ইমরান একজন পাইকারের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকার টুপি বাকিতে আনলেন। শর্ত ছিল, ৬০ দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে হবে। সেই অনুযায়ী, সময়মতো পাইকারের অর্থ ফেরতও দিলেন। এক বছরের মাথায় হঠাৎ ফেসবুকে হেড গিয়ারের পেজটি হারিয়ে যায়। এতে ক্রেতা ও অনুসরণকারীদের হারিয়ে ফেললেন তাঁরা।
ইমরান ও ইফতেখার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফেসবুক পেজ হারানোর পর হেড গিয়ারের ব্যবসা পুনরুদ্ধার ও সম্প্রসারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই ইকরামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তখন ইকরামুল তাঁর বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনসে হেড অব সাপ্লাই চেইন হিসেবে কাজ করছেন। একপর্যায়ে ইমরানের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার সম্ভাবনা দেখে ব্যবসার অংশীদার হতে রাজি হলেন ইকরামুল। সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিলেন হেড গিয়ারে।
হেড গিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমরা মূলত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্টকলটের টুপি কিনে নিজেদের ব্র্যান্ডে বিক্রি করতাম। হঠাৎ ফেসবুক এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের কপি পণ্য বিক্রেতাদের পেজ বন্ধ করে দেয়। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজেরা টুপি ডিজাইন ও উৎপাদন করব। তত দিনে আমরা জেনে গেছি, দেশে টুপির একটা বড় বাজার আছে।’
বাজার থেকে টুপি কিনে তা আবার বিক্রি করার মাধ্যমে শুরু হলেও বর্তমানে হেড গিয়ার নিজস্ব পণ্যই বিক্রি করে। এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক নকশার টুপি বাজারে এনেছে তারা। তার মধ্যে বর্তমানে ৩৫০ ধরনের নকশার টুপি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তিন কর্মী নিয়ে শুরু করা এই টুপির ব্র্যান্ডে বর্তমানে কাজ করছেন ১৭ জন।
ইকরামুল হক বর্তমানে হেড গিয়ারের উৎপাদন ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট দেখছেন। ইমরান দেখেন নকশা ও বিপণন। আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গ্রাহকসেবা দেখভাল করেন।
হেড গিয়ারে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে ইকরামুল হক বলেন, ‘আমি আট বছর তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেছি। সেখানে বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুনের মধ্যে আমরা বিশ্বের খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করতাম। পোশাকশিল্পে সবাই কারখানা বড় করতে চায়। কেউ বড় ব্র্যান্ড করার চিন্তা করে না। আমি প্লামি ফ্যাশনসে কাজের পাশাপাশি একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড করার চেষ্টা করেছিলাম। ইমরানের সঙ্গে আগেও ব্যবসা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। টুপির বাজারে একটা ব্র্যান্ডের শূন্যতা ছিল। তা ছাড়া হেড গিয়ারের প্রথম বছরের অভিজ্ঞতাও ভালো ছিল। সব মিলিয়ে তাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত হলাম।’
হেড গিয়ারের পাশাপাশি বর্তমানে দেশে ১০-১২টি টুপি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। তবে প্রতিযোগীদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য গড়তে সচেতনভাবে কাজ করেন বলে জানালেন ইকরামুল হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের পণ্যের কাপড় উন্নত মানের। ক্রেতারা কিনে সন্তুষ্ট। আমাদের সফলতা এখানেই।’
এ বিষয়ে ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমাদের পরিচিত অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, টুপি কারা কেনে। প্রতিবছর আমাদের দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশ-বিদেশে ঘুরতে যান। আমরা তাঁদের কাছে বছরে অন্তত ১টি করে টুপি বিক্রি করতে চাই।’
হেড গিয়ার প্রতিটি ডিজাইনের টুপি প্রথম চালানে ১০০টি উৎপাদন করে। পরে চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়ানো হয়। বর্তমানে হেড গিয়ারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁরা কাজ করছেন।
গত মাসে দুবাইয়ে জিটেক্স আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ৯২টি দেশের ৯ হাজার স্টার্টআপ কোম্পানি অংশ নেয়। তার মধ্যে হেড গিয়ারও ছিল। ইকরামুল হক বলেন, ‘প্রদর্শনীতে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। ফলে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে আমরা বড় সম্ভাবনা দেখছি। ভারতের একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে এরই মধ্যে আমাদের কথা হয়েছে। ভারতের মতো বিশাল বাজারে মাত্র ১-২টি টুপির ব্র্যান্ড আছে। ফলে সেখানেও বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। আমরা নিজেদের ব্র্যান্ডের ব্যবসা বিশ্বদরবারে নিয়ে যেতে চাই। এই লক্ষ্যেই এখন কাজ করছি।’
প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন বলেন, নতুন করে কেউ ব্যবসায় আসতে চাইলে প্রথমে তাঁদের বাজার নিয়ে একটু গবেষণা করা ভালো। তারপর শুরু করতে হবে। ব্যবসায় নিজেদের ধরে রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোক্তাদের জন্য।