আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার-২০২৩-এ সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছেন ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেডের উদ্যোক্তা এ এস এম আশিকুর রহমান। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সাহায্য করতে ২০১৭ সালে গড়ে তোলা এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে মোট বিনিয়োগ বর্তমানে ৭০ লাখ টাকা।
আর পাঁচটা শিশুর মতোই বেড়ে উঠছিলেন আশিকুর রহমান। মা-বাবা-বোনদের স্নেহ-ভালোবাসা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, হইহুল্লোড় আর পড়াশোনায় মেতে ছিলেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমতে লাগল। একপর্যায়ে পুরোপুরি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে গেলেন আশিকুর। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। মোহাম্মদপুরের আদাবরে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে পৃথিবীটাকে নতুন করে অনুভব করতে শুরু করলেন আশিকুর। টের পেলেন, আগের মতো খেলার সুযোগ নেই। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এল—পড়াশোনা কীভাবে এগিয়ে নেবেন। ঢাকায় তাঁর উপযোগী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে না পেয়ে কুমিল্লার একটি স্কুলে আশিকুরকে ভর্তি করানো হলো। সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের উপযোগী ব্রেইল বইয়ের সংখ্যা ছিল কম। একেকটি বই তিন-চারজনকে ভাগ করে পড়তে হতো। একদিন একজন একটি বিষয় পড়তেন, তো অন্যজন পড়তেন আরেকটি বিষয়। এভাবেই কুমিল্লা বোর্ড থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলেন আশিকুর।
অবশ্য আশিকুর এখানে থেমে যাননি। পরবর্তীকালে তিনি গড়ে তোলেন ‘ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সাহায্য করতে ২০১৭ সালে গড়ে তোলা এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে মোট বিনিয়োগ বর্তমানে ৭০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে গড় বিক্রি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করেন ১০ জন কর্মী। বাংলাদেশে প্রথম সহায়ক এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান একটি বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) প্রতিষ্ঠান।
আশিকুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত ইনোভেশন গ্যারেজ মূলত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ‘প্রবেশগম্য প্রযুক্তি’ (অ্যাকসেসিবল টেকনোলজি) ও ‘সলিউশন’ নিয়ে কাজ করে। যেসব প্রযুক্তি বাংলা ভাষায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য এখনো সহজলভ্য নয়, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি উদ্ভাবন ও বিপণন নিয়ে কাজ করে তারা।
নিজেকে যেভাবে গড়লেন আশিকুর
মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক শেষ করে প্রথম একটি এনজিওতে চাকরি নেন আশিকুর রহমান। সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। তখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের পরীক্ষার সময় একজন শ্রুতলেখক দেওয়া হতো। তবে কম্পিউটার দক্ষতার পরীক্ষায় দেখা যেত, দক্ষ শ্রুতলেখক পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আশিকুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সব পরীক্ষায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের নিজেদের পরীক্ষা নিজেদেরই দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ উদ্যোগে সফল হন তাঁরা। ২০১০ সালে বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের প্রথম কোনো ব্যাচ কোনো শ্রুতলেখক ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
২০১২ সালে আশিকুর একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পরের চার বছর বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কোথাও পরামর্শক, কোথাও অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। আশিকুর বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গে খুব বেশি মিশতে চাইতেন না। কম্পিউটারের কাজ করতেও বড় সমস্যায় পড়তে হতো। তার কারণ, প্রযুক্তিশিল্পে যেসব পণ্য তৈরি হয়, সেগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। তখনই আশিকুর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কিছু করবেন।
আশিকুর শুরুতে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে সহায়তা চাইলেন। তবে খুব একটা সাড়া পেলেন না। তখন আশিকুর উপলব্ধি করলেন, যা করার নিজেকেই করতে হবে। ২০১৬ সালের মে মাসে চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা শুরু করলেন। সে সময় আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেলে পরিবারের সমর্থন পান। পড়াশোনা শেষে কিছুদিন গবেষণার পর ইনোভেশন গ্যারেজ গড়ে তোলেন আশিকুর। ২০১৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান একটি অ্যাপ তৈরি করে। সেই অ্যাপের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষেরা স্মার্টফোনে পড়তে পারবেন।
দেশের আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ইনোভেশন গ্যারেজ কাজ করছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে সহায়তা না দিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো এনজিও বা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য করে। ইতিমধ্যে তারা জাহাঙ্গীরনগর ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে।
আশিকুর রহমান বলেন, তাঁরা একই সঙ্গে টেক্সট ও ব্রেইল সিস্টেমযুক্ত নেমপ্লেট, বিজনেস কার্ড বা ক্যালেন্ডার ডিজাইন করছেন। ব্রেইল প্রিন্টিংয়ের কাজও করেন। বইমেলায় স্পর্শ ফাউন্ডেশনের বই বা অন্যান্য পণ্যের কাজ করছেন। ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সট বুকের (এনসিটিবি) প্রাক্-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক উৎপাদন করেন তাঁরা। চার বছর গবেষণার পর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের ব্যবহার উপযোগী মাউসও তৈরি করেছেন।
এত কিছু কীভাবে করলেন? এমন প্রশ্নে আশিকুরের বিনয়ী উত্তর, ‘সত্যি বলতে গেলে, আমি আসলে অন্যদের কথা ভেবে কাজ করিনি। আমি কাজ করেছি নিজের জন্য। নিজে যে সমস্যায় পড়েছি বা পড়তাম, তার সমাধানগুলো বের করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যদি বড় বিনিয়োগ থাকত, তাহলে নিজেরা অনেক পণ্য উৎপাদন করতে পারতাম। ১ লাখ টাকার পণ্য ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় দিতে পারতাম।’
আশিকুর মনে করেন, সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষের জন্যই বাংলাদেশে সবাইকে চাকরি দেওয়া অসম্ভব। তবে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের চাকরির অভাব হবে না। এ জন্য তাঁদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ লোক বিদেশি মার্কেটপ্লেসে কাজ করেও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন।
সম্মাননা
২০২২ বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডস ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে সম্মানজনক পুরস্কার ‘বাংলার জন্য এআই’ পেয়েছেন।