হাতে বানানো সুগন্ধি সাবান যাচ্ছে নরসিংদী থেকে জাপানে

ইকেবানা কারখানায় তৈরি হচ্ছে হাতে বানানো সুগন্ধি সাবান
ইকেবানা কারখানায় তৈরি হচ্ছে হাতে বানানো সুগন্ধি সাবান

নিম, গোলাপ, কফি, জাফরান কিংবা অ্যালোভেরা ইত্যাদি উপকরণে বানানো হয় বিভিন্ন সুগন্ধি সাবান। নাম তার ইকেবানা। নরসিংদীর ঘোড়াশালে ছোট্ট একটি কারখানায় এই হারবাল সাবান তৈরি করেন উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। দেশে তৈরি হলেও তাঁর এই সাবানের মূল বাজার জাপান। এ ছাড়া আরও পাঁচের অধিক দেশে রপ্তানি হয় ইকেবানা।

২০০৭ সালে প্রায় ৬০ হাজার টাকা পুঁজি বিনিয়োগে বিশেষ এই সাবান তৈরি শুরু করেন আনিসুর রহমান। পর্যায়ক্রমে তাঁর সাবানের কদর বাড়তে থাকে। বর্তমানে বছরে গড়ে ৫০ হাজার সাবান রপ্তানি করেন এই উদ্যোক্তা। এ ছাড়া স্থানীয় বাজারে বিক্রি তো আছেই।

উদ্যোক্তা আনিসুর রহমানের বাড়ি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার খানিপুর এলাকায়। ছোটবেলায় চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও পরে নানা সীমাবদ্ধতায় তা হয়ে ওঠেনি। এ জন্য উচ্চমাধ্যমিক শেষে বিজ্ঞানের ছাত্র আনিসুর ভর্তি হন ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে স্নাতক ও ২০০০ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতকোত্তরে থাকা অবস্থায় তাইওয়ানের একটি কোম্পানিতে খণ্ডকালীন কাজ নেন। পড়াশোনা শেষে বছরখানেক পর সেখানেই পূর্ণকালীন কাজ শুরু করেন। তবে আরও বড় পরিসরে কাজের সুযোগ খুঁজছিলেন আনিসুর।

আনিসুর রহমান

২০০২ সালের কথা। আনিসুরের পরিচিত এক বড় ভাই নতুন একটি কাজের সন্ধান দিলেন। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে চায় একটি জাপানি কোম্পানি। তারা মূলত এ দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য আমদানি করবে। তো ওই কোম্পানির নিবন্ধন থেকে শুরু করে পণ্য সংগ্রহ, রপ্তানি ইত্যাদি সমন্বয়ের কাজ করতে হবে। কৃষিপণ্য নিয়ে আগে থেকেই আগ্রহ ছিল আনিসুরের। তাই রাজি হয়ে গেলেন।

আনিসুর রহমান জানান, কোম্পানিটির হয়ে জাপানে হলুদ, পেয়ারাপাতা, নিমপাতা ইত্যাদি পণ্য পাঠাতেন তিনি। বছর চারেক কাজ করলেন। এরই মধ্যে নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেন।

২০০৬ সালে চাকরি ছেড়ে নিজেই একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন আনিসুর। নাম দিলেন বাংলা ন্যাচারাল অ্যাগ্রো লিমিটেড। চাকরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জাপানে হলুদসহ বিভিন্ন পণ্য পাঠানোর কাজ শুরু করলেন। পরের বছরের মার্চ মাসে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন বা জেটরোর সহায়তায় একটি খাদ্য ও কৃষিপণ্য মেলায় অংশ নিতে জাপান যান। সঙ্গে নেন হলুদ, পেয়ারাপাতা, নিমপাতা ইত্যাদি পণ্য। এসব পণ্যের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে তৈরি কয়েকটি নিম সাবানও সঙ্গে নিলেন। এই সাবানই উদ্যোক্তা হিসেবে বড় সাফল্য নিয়ে আসে তাঁর জন্য।

আনিসুর জানান, সে সময় দেশে নিম সাবানের তেমন প্রচলন ছিল না। নিম হাকিম নামের মহাখালী এলাকার এক বাসিন্দা এই সাবান বানাতেন। তাঁর কাছ থেকে কয়েকটি সাবান সঙ্গে নিয়ে জাপানের মেলায় যান। সেখানে এক জাপানি গ্রাহক নিম সাবান দেখে খুব পছন্দ করেন এবং ৫ হাজার ডলারের ক্রয়াদেশ দেন।

ক্রয়াদেশ পেয়ে বেশ উৎফুল্ল আনিসুর রহমান। কারণ, এটি তাঁর জন্য অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো ঘটনা। তবে বিপত্তি বাধে দেশে ফেরার পর। নিজে তো সাবান বানাতে পারেন না। ভেবেছিলেন, কাউকে দিয়ে সাবান বানিয়ে জাপানে পাঠাবেন। কিন্তু বেশ কয়েকটি সাবান কোম্পানিতে ঘুরেও কোনো উপায় বের করতে পারলেন না।

কিছুদিন পর রাজধানীর পুরান ঢাকায় আনু মিয়া নামের এক সাবান তৈরির কারিগরের খোঁজ পান আনিসুর। তবে সেখানে গিয়ে শুরুতে হতাশ হতে হয় তাঁকে। কারণ, আনু মিয়া তত দিনে সাবান তৈরির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। কারখানাও পরিত্যক্ত। তবে শেষ পর্যন্ত আনু মিয়াকে রাজি করাতে পারলেন আনিসুর। কারখানাটি ভাড়া নিলেন। তারপর ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে নতুন করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনে সংযোজন করলেন। এরপর আনু মিয়ার সহযোগিতায় নিম সাবান বানিয়ে জাপানে পাঠালেন।

সেই থেকেই সাবান রপ্তানি শুরু করলেন আনিসুর রহমান। পরের বছর আবার আরেকটি মেলায় অংশ নিতে জাপানে গেলেন। এবার তাকিউচু শিনোহারা নামের এক জাপানি সাবান তৈরির কারিগরের সঙ্গে পরিচয় হলো। এ যাত্রায় কয়েক দিন সেখানে থেকে ওই জাপানির কাছ থেকে সাবান তৈরির কৌশল রপ্ত করেন তিনি।

আনিসুর বলেন, ‘সুগন্ধি সাবানের যে কত ধরন হতে পারে, একটা সাবান যে কতটা স্বচ্ছ হতে পারে—সেসব আমি তাকিউচু শিনোহারার কাছ থেকে শিখেছিলাম। তিনি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এসেও আমাকে কাজ শিখিয়েছেন।’ ২০০৯ সালে আবার জাপানে মেলায় যান আনিসুর। সঙ্গে নেন নিজের তৈরি বেশ কিছু সাবানের নমুনা। সেখান থেকে প্রায় ৬০ হাজার পিস সাবানের ক্রয়াদেশ পান তিনি।

এরপর আর সাবান রপ্তানির ক্রেতার জন্য পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আনিসুরকে। তখন থেকে নিয়মিতই জাপানে সাবান রপ্তানি করছেন আনিসুর। পুরান ঢাকার সেই কারখানাতেই ১৪ বছর সাবান তৈরি করেন। ২০২০ সালে করোনা শুরু হলে কারখানা নরসিংদীর নিজ গ্রামে সরিয়ে নেন।

বর্তমানে আনিসুর রহমানের কারখানায় কাজ করেন ১৩ জন কর্মী। আর সেখানে তৈরি হয় ১৫ ধরনের সাবান। কফি, মরিঙ্গা (সজনে), লাভেন্ডার, জাফরান, অ্যালোভেরা, নিম, রোজ (গোলাপ) ইত্যাদি সুগন্ধির সাবান তৈরি করেন এই উদ্যোক্তা। বছরে প্রায় ৫০ হাজার পিস সাবান রপ্তানি করেন আনিসুর।

জাপান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কাতার ও দুবাইয়ে সরাসরি সাবান রপ্তানি করেন তিনি। এ ছাড়া অনেক বাংলাদেশি স্যুভেনির হিসেবে তাঁর কাছ থেকে সাবান কিনে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান।

নিজের তৈরি সাবানের বিশেষত্বের কথাও জানান আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাজারে প্রচলিত বাণিজ্যিক সাবানে সাধারণত পাম অয়েল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমার সাবানে অলিভ, নারিকেল, ক্যাস্টার, রাইস ব্র্যান (ধানের কুঁড়া) ও সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করি। প্রাকৃতিক উপায়ে ও প্রাকৃতিক উপকরণে এই সাবান তৈরি হয়। আর সুগন্ধি বাড়াতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন এসেনশিয়াল অয়েল।’