বিশ্বখ্যাত মার্কিন কোম্পানি এমজিএফ সোর্সিংয়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর পদ ছেড়ে দিয়ে বায়িং হাউসের ব্যবসা শুরু করেন ক্য চিন ঠে (ডলি)। সময়টা ২০১৯ সালের নভেম্বর। কয়েকজন কর্মীও নিয়োগ দেন। এরপর ক্রয়াদেশের আশায় লাগেজ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা চষে বেড়ান। আশা ছিল, ক্রয়াদেশ মিলবে, ব্যবসার চাকা ঘুরবে। কিন্তু কিসের কী, করোনা এসে সব ওলটপালট করে দিল।
২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রকোপ বাড়লে কর্মীদের বাড়িতে পাঠিয়ে অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন ডলি। জমানো অর্থে কর্মীদের বেতন আর অফিস ভাড়া দিলেন। সাড়ে তিন মাস পর অফিস খুললেন। তারপরও বড় কোনো ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন না। এভাবেই কেটে গেল ৯ মাস। কিন্তু মনোবল হারাননি। নিজেকে নিজেই সাহস দিয়েছেন। একপর্যায়ে সত্যি সত্যি বড় একটা ক্রয়াদেশ পেলেন। এরপরের গল্প শুধুই এগিয়ে যাওয়া।
উদ্যোক্তা ডলির বায়িং হাউস-ক্লথ ‘আর’ আস লিমিটেড বর্তমানে ইউরোপের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানে কর্মী সংখ্যা এখন ১২। শিগগিরই ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও করছেন ডলি।
কক্সবাজারের চকরিয়ার রাখাইন সম্প্রদায়ের মেয়ে ডলি উদ্যোক্তা হওয়ার আগে দুই দশকে বিশ্বখ্যাত কয়েকটি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। পরিবার ছেড়ে বিদেশেও চাকরি করেছেন। এভাবেই একটু একটু করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন।
উত্তরায় ক্লথ ‘আর’ আসের কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার ডলির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়। আলাপকালে তিনি জানান, পূর্বপুরুষের ভিটা কক্সবাজারের চকরিয়ায় হলেও তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে। বাবা মং খেজারির স্ক্রিন প্রিন্ট ও ডাইংয়ের ব্যবসা ছিল চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজারে। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে ডলি দ্বিতীয়। মা এ্যাইক্য য়ীন ছিলেন গৃহিণী।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় সেন্ট স্কলাস্টিকা গার্লস হাইস্কুলে ডলিকে ভর্তি করা হয়। সবই ঠিকঠাক চলছিল। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে ডলির বাবার ব্যবসা খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন মং খেজারি। আর তিনি ঢাকায় এসে চাকরি নিলেন।
গ্রামে ফিরে ডলি ভর্তি হন চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়ন হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে। এখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দিলেন। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে। হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করলেন। এইচএসসি পাসের পর এলেন ঢাকায়। দ্রুত পড়ালেখা শেষ করে পরিবারের হাল ধরতে ডলিকে পরামর্শ দিলেন তাঁর বাবা। তখন তিনি অসুস্থ। তাই অনার্স না করে তেজগাঁও কলেজে বিকমে ভর্তি হন ডলি।
বিকম শেষ করে ১৯৯৭ সালে বিশ্বখ্যাত সোর্সিং কোম্পানি লিঅ্যান্ডফাংয়ে চাকরি নেন তিনি। ডলি বলেন, ‘আমাকে কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজারের সেক্রেটারি ও অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার পদের জন্য অফার দেওয়া হয়। সেক্রেটারি পদে ১৫ হাজার, আর মার্চেন্ডাইজার পদের বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি মার্চেন্ডাইজার পদেই ইন্টারভিউ দিলাম। ইংরেজিতে মোটামুটি ভালো হওয়ায় চাকরির সুযোগ পেয়ে গেলাম। কোম্পানি থেকে বলা হয়, ছয় মাসের মধ্যে যোগ্যতা দেখাতে না পারলে বাদ দেওয়া হবে। আমি চ্যালেঞ্জটা নিলাম।’
এরপর দ্রুতই নিজের অবস্থান পোক্ত করলেন ডলি। পদোন্নতি হতে লাগল। এভাবে টানা ১৩ বছর কাজ করলেন। তত দিনে তিনি লিঅ্যান্ডফাংয়ের সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার ম্যানেজার। চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। প্রথমে এলএলবি করেছেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এমকম এবং ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে এমবিএ করেন।
লিঅ্যান্ডফাংয়ে কাজ শুরুর দুই বছরের মাথায় বাবাকে হারান ডলি। তারপর একসময় বড় বোনও ব্রেনস্ট্রোকে মারা যান। তাতে পরিবারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল ডলি ও তাঁর ভাইয়ের ওপর। তাঁরা দুজন মিলে ছোট তিন ভাইবোনের পড়াশোনা চালিয়ে নিলেন।
লিংঅ্যান্ডফাংয়ে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার ম্যানেজার হওয়ার পর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনায় ছিলেন ডলি। কারণ, সেখানে পদোন্নতি পাওয়াটা কঠিন। তত দিনে বিয়েশাদি করেছেন। দুটি ছেলেও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লিংঅ্যান্ডফাং ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র পিভিএইচ করপোরেশনের ঢাকা কার্যালয়ে ডিভিশনাল মার্চেন্ডাইজার হিসেবে যোগ দেন। ডলি বলেন, ‘লিঅ্যান্ডফাংয়ে চাকরি করার সময় আমি ইউরোপের ব্র্যান্ড এমএস মোডের ব্যবসা দেখতাম। পিভিএইচে কাজ শুরুর কয়েক মাস পর এমএস মোড থেকে আমাকে কল করল। তারা ঢাকায় অফিস করতে চায়। আমাকে কান্ট্রি হেড হিসেবে যোগ দেওয়ার অফার করে। ২০১৩ সালে এমএস মোডের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করি।’
এখানে কাজ করতে করতে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তাভাবনা উঁকি দিতে থাকে ডলির। নিজে নিজেই ভাবলেন, এ জন্য বিদেশে কাজের অভিজ্ঞতাটা থাকলে ভালো হয়। তাই বিদেশে চাকরি খুঁজতে লাগলেন ডলি।
একপর্যায়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এমজিএফ সোর্সিং থেকে প্রস্তাব পেলেন। পদ ডিভিশনাল ম্যানেজার। কাজ করতে হবে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। ২০১৫ জাকার্তায় এমজিএফ সোর্সিংয়ে যোগ দিলেন ডলি। জাকার্তায় এক্সপ্রেস নামের একটি ব্র্যান্ডের ব্যবসা দেখভাল করতেন ডলি। একপর্যায়ে তিনি দেখলেন এক্সপ্রেস যে দামে ডেনিম প্যান্ট ও শার্ট কিনছে, তার চেয়ে অনেক কমে বাংলাদেশে উৎপাদন সম্ভব। ভেবেচিন্তে এক্সপ্রেসের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশ স্থানান্তর করতে কোম্পানিকে অফার দিলেন। এমজিএফও রাজি হয়ে গেল।
জাকার্তায় দেড় বছর কাজ করে এমজিএফ সোর্সিংয়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে ঢাকায় চলে এলেন ডলি। সঙ্গে নিয়ে এলেন দুই কোটি ডলারের ব্যবসা। এর মধ্যে চাকরি থেকে ধীরে ধীরে মন উঠতে লাগল তাঁর। নিজেই কিছু করার তাগিদ অনুভব করলেন। ২০১৯ সালের মে মাসে চাকরি ছেড়ে দিলেন। শুরু করলেন বায়িং হাউসের ব্যবসা। কিন্তু শুরুতেই তাতে বাদ সাধল করোনা। কঠিন বিপদে পড়লেন ডলি। ক্রয়াদেশ নেই। গাঁটের পয়সায় কর্মীদের বেতন দিতে হচ্ছে। এরপর ২০২১ সালের মার্চে এসে প্রথম বড় ক্রয়াদেশ পেলেন।
সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে ডলি বললেন, ‘আমার মা মারা গেছেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে মাকে নিয়ে বাড়িতে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় ইউরোপ থেকে একটা কল এল। আমার পরিচিত এক বান্ধবী নতুন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। সে বলল, তারা পোশাক সোর্সিংয়ে সমস্যায় পড়ছে। আমি সাহায্য করতে পারব কি না। তার কথা শেষ হলে আমি বললাম, আমার মা মারা গেছেন। এক সপ্তাহ পর আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
ডলি বলেন, ‘ইউরোপের ব্র্যান্ডটির কাছ থেকে আমরা এক লাখ পিস লেগিংস তৈরির কাজ পেয়েছিলাম। সেটিই আমাদের প্রথম বড় ক্রয়াদেশ। এরপর আমাদের আর সমস্যা হয়নি।’
ডলি ইতিমধ্যে সফল উদ্যোক্তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। গত মাসে ডিএইচএল-ডেইলি স্টারের বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। উদ্যোক্তার বাইরে ডলি একজন দৌড়বিদ। ম্যারাথনে অংশ নেন নিয়মিত। লেখালেখিও করেন।
বায়িং হাউস মূলত বিদেশি ব্র্যান্ড ও দেশীয় কারখানার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। দেশে এক হাজারের মতো বায়িং হাউস আছে। এই খাতে নতুনদের ব্যবসার সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে ডলি বলেন, দেশে আড়াই হাজারের মতো পোশাক কারখানা আছে। তাদের মধ্যে ৩০০-৪০০ কারখানার মার্কেটিং টিম আছে। বাকিদের কিন্তু নেই। বায়িং হাউসগুলোই তাদের জন্য ব্যবসা নিয়ে আসে। ফলে বায়িং হাউসের ব্যবসার সুযোগ আছে।
বায়িং হাউসের ব্যবসায় আসতে আগ্রহীদের জন্য পরামর্শ কী, জানতে চাইলে ডলি বলেন, নিজের কাজটা ভালোভাবে জানতে হবে। দক্ষতা থাকতে হবে। আর কোনো জায়গা থেকে সহায়তা মিলবে না, এটা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।
আলাপের শেষ পর্যায়ে ডলির কাছে প্রশ্ন ছিল—চাকরি না ব্যবসা, কোনটা ভালো। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ব্যবসা। কারণ, স্বাধীনতা আছে। আবার নিজের সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর সুযোগও রয়েছে।’