ম্যাজিকম্পোস্ট নামের এ জৈব সার ব্যবহৃত হচ্ছে ফসলের মাঠ, ছাদবাগান ও চিংড়ির খামারে। প্রতি কেজি সারের দাম ৩০ টাকা। এই সার বিক্রি করে আসলাম হোসেনের মাসিক আয় হয় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।
টন টন কাঁকড়ার খোলস শুকিয়ে তা যন্ত্রের সাহায্যে গুঁড়া করা হয়। এটি ক্র্যাব শেল পাউডার (সিএসপি) নামে পরিচিত। এই সিএসপি পরে নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশানো হয় পচে যাওয়া (প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে) শাকসবজির সঙ্গে। এভাবে রেখে দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই তৈরি হয় একধরনের সার।
কাঁকড়ার খোলস দিয়ে ম্যাজিকম্পোস্ট নামে পটাসিয়ামসমৃদ্ধ এই জৈব সার তৈরি করছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের নওয়াবেঁকী এলাকার বাসিন্দা মো. আসলাম হোসেন। মাঠে ফসল উৎপাদন, ছাদবাগান ও চিংড়ির খামারে ব্যবহৃত হয় এ সার। ম্যাজিকম্পোস্ট বিক্রি করে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করেন আসলাম হোসেন।
লবণাক্ততাপ্রবণ উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় গত কয়েক বছরে কাঁকড়া চাষ বেড়েছে। অনেকে চিংড়ি চাষ ছেড়ে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকেছেন। জলবায়ু সহনশীলতা, রোগের প্রতি কম সংবেদনশীলতা, সহজ চাষ পদ্ধতি ও ভালো বাণিজ্যিক মূল্যের কারণে সাতক্ষীরায় কাঁকড়া চাষ ক্রমেই বাড়ছে।
চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিপত্তি দেখা দিয়েছে কাঁকড়ার খোলস নিয়ে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বাণিজ্যিকভাবে হার্ড শেল (শক্ত খোল) ও সফট শেল (নরম খোল)—এই দুই ধরনের কাঁকড়া চাষ হয়। তবে নরম খোলের কাঁকড়ার রপ্তানি চাহিদা বেশি; ফলে উৎপাদনও বাড়ছে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় সাড়ে ৩০০ খামারে এ ধরনের কাঁকড়া উৎপাদন হচ্ছে। এসব খামারেই মূলত কাঁকড়ার শক্ত খোলস পাওয়া যায়।
দেশের অভ্যন্তরে কাঁকড়ার খোলসের বাণিজ্যিক ব্যবহার কম। কিছু পরিমাণ খোলস গুঁড়া করে চীনে রপ্তানি হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ খোলসই বর্জ্য আকারে ভাগাড় বা নদীসহ আশপাশে ফেলা দেওয়া হতো, যা দুর্গন্ধ ও দূষণ ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে। কিন্তু কাঁকড়ার খোলসের টেকসই ব্যবসায়িক সমাধানের মাধ্যমে পরিবেশগত এ চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করেছেন আসলাম।
কাঁকড়ার খোলসের গুঁড়া দিয়ে জৈব সার তৈরির এ প্রকল্পে আসলাম হোসেনকে যৌথভাবে অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও বিশ্বব্যাংক। পিকেএসএফের সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের (এসইপি) আওতায় এ সহায়তা দেওয়া হয়। আর এ কাজে স্থানীয়ভাবে তাকে সহযোগিতা করেছে নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন (এনজিএফ)।
যেভাবে শুরু
শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ও আটুলিয়া ইউনিয়নে পিকেএসএফের এসইপি প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু কাঁকড়ার খামার রয়েছে। এসব খামারে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ হয়। ফলে প্রচুর পরিমাণে খোলস উৎপন্ন হয় সেখানে। পিকেএসএফের পরামর্শে স্থানীয় গণমুখী ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা এসব খোলসের বিকল্প বাণিজ্যিক ব্যবহারের প্রকল্প নেন।
সময়টা বেশি দিন আগের নয়, ২০২১ সালের কথা। এনজিএফ থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে কাঁকড়ার খোলস থেকে সার তৈরির উদ্যোগ নেন আসলাম। এক লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে বাড়ির পাশেই টিনের ছাউনি দিয়ে আলাদা জায়গা ও পিট (চারটি বড় ট্যাংকসহ) তৈরি করেন।
আসলাম হোসেন জানান, কাঁকড়ার খোলসের গুঁড়ার সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে পচানো সবজি মিশিয়ে এ সার তৈরি করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এর সঙ্গে গোবর, কেঁচো সার, ছাই, নিমপাতা প্রভৃতি যোগ করা হয়। এ সার তৈরির জন্য স্থানীয় বিভিন্ন খামার থেকে কাঁকড়ার শুকনা খোলস সংগ্রহ করেন তিনি। এরপর এসব খোলস যন্ত্রের সাহায্যে গুঁড়া করা হয়। সাধারণত ২৫০ কেজি খোলস থেকে ২০০ কেজি গুঁড়া পাওয়া যায়।
অন্যদিকে স্থানীয় সবজির পাইকারি বাজার ও বাসাবাড়ি থেকে শাকসবজির বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। নির্দিষ্ট কুয়ার মধ্যে এসব সবজি ১৫ দিনের মতো রেখে তারপর এর সঙ্গে কাঁকড়ার খোলসের গুঁড়া মেশানো হয়। এভাবে দেড় থেকে দুই মাস রেখে দিলে তা থেকে উচ্চমানের ম্যাজিকম্পোস্ট জৈব সার তৈরি হয়। এরপর সেগুলো রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে বাজারজাত করা হয়। প্রতি কেজি ম্যাজিকম্পোস্ট তৈরিতে ব্যয় হয় ১২–১৫ টাকার মতো; আর তা বিক্রি করেন ৩০ টাকায়।
বর্তমান অবস্থা
কাঁচামালের সরবরাহ থাকায় সারা বছরই এ সার উৎপাদন করতে পারছেন আসলাম হোসেন। তিনি জানান, ২০২১ সালের মাঝামাঝি উৎপাদন শুরুর প্রথম তিন-চার মাসে দেড় হাজার কেজি ম্যাজিকম্পোস্ট সার পান। সেগুলো গণমুখী ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ছাদবাগান ও কৃষিখেতে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। এতে সফলতা পেয়ে পরে দুটি শীতকালীন সবজির ওপরে এই সারের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়। এ ছাড়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারেও এ সারের মান যাচাই করা হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় আটুলিয়া পরিবেশ উন্নয়ন ক্লাবের মাধ্যমে এই সার বিক্রি করা হচ্ছে।
আসলাম হোসেন জানান, তিনি নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে বাণিজ্যিকভাবে সারা দেশে এ সার বিক্রি করতে চান। এ জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ম্যাজিকম্পোস্ট ব্যবহারের চাহিদা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে চিংড়ির ঘেড়ে ব্যবহারের জন্য স্থানীয় ৩০টি খামারের মালিকের কাছে এ সার বিক্রি করা হচ্ছে। আবার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সবজি চাষ করছেন, এমন ২০ জন চাষিও এ সার ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া বাসাবাড়ির ছাদবাগানের জন্যও অনেকে ম্যাজিকম্পোস্ট সার কিনছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও দূর থেকে অনেকে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন।
আসলাম হোসেনের পারিবারিক ব্যবসা চিংড়ি চাষ। বর্তমানে ৭ একর জায়গায় তিনি চিংড়ি চাষ করছেন। তবে ম্যাজিকম্পোস্ট সার তৈরির সফলতা তাঁকে এ খাতে বেশি আগ্রহী করে তুলেছে। আসলাম হোসেন বলেন, ‘আমি বড় পরিসরে কাঁকড়ার খোলসের সার উৎপাদন করতে চাই। এ জন্য আরও অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি কেনা প্রয়োজন। ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কিংবা বিনিয়োগ পেলে এই উদ্যোগ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।’