ব্যর্থতাই যাঁদের সফলতার চাবিকাঠি

বলা হয়, ‘একজন মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসাটা খুব দরকার। কঠিন সময়ের কারণেই মানুষ সাফল্য উপভোগ করতে পারে।’ সফল হতে হলে জীবনে ব্যর্থতা যেন অবশ্যম্ভাবী। তারপরও অনেকেই ব্যর্থতাকে নিয়তি মনে করে সরে পড়েন। যাঁরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উৎসাহে সামনে এগিয়ে যান, তাঁরাই সফল হন। পৃথিবীজুড়ে যাঁদের আমরা সাফল্যের শিখরে দেখছি, তাঁরাও কিন্তু জীবনের কোনো না কোনো সময় ব্যর্থতার স্বাদ পেয়েছেন।

সইচিরো (soichiro) হোন্ডা
সইচিরো (soichiro) হোন্ডা

টয়োটায় চাকরি না পেয়ে নিজেই বানালেন হোন্ডা

একটা সময় এমন ছিল, হোন্ডা যে একটি মোটরসাইকেলের কোম্পানির নাম, তা আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। মনে করা হতো, মোটরসাইকেলের আরেক নাম হোন্ডা। তবে এই হোন্ডা ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা জাপানের সইচিরো (soichiro) হোন্ডাকে বারবার নিতে হয়েছে ব্যর্থতার স্বাদ। ছোটবেলা থেকে কলকবজা নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান সইচিরো। তাঁর ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যান রাজধানী টোকিওতে। সেখানে কাজ নেন একটি গ্যারেজে। ওই গ্যারেজে তাঁর কাজ ছিল কলকবজা পরিষ্কার করা ও গ্যারেজমালিকের বাচ্চাদের দেখাশোনা। ইচ্ছা ছিল টয়োটা কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার। সেইমতো গেলেন ইন্টারভিউ দিতে। তবে স্বপ্নের ওই চাকরি কপালে জোটেনি তাঁর। কিন্তু এই ব্যর্থতা তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। নিজ ঘরে বসেই বানাতে শুরু করেন স্কুটার। চেষ্টার ত্রুটি না করে রাতের পর রাত নিরলস পরিশ্রম করে যান। অবশেষে ১৯৪৬ সালে সফল হন। তৈরি করেন মোটরচালিত সাইকেল। আর ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন হোন্ডা মোটর কোম্পানি। সইচিরোর শ্রম ও সাধনার বদৌলতে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি একসময় হয়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত হোন্ডা কোম্পানি।

মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস

মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি বিল গেটসের প্রথম কোম্পানি

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের জীবনের অনেক কিছু এখন আমাদের জানা। ১৩ বছর ধরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তবে তাঁর জীবনেও রয়েছে বেশ কিছু ব্যর্থতার কাহিনি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থী বিল গেটস শুরু করেন ব্যবসা। তাঁর জীবনের প্রথম ব্যবসা ট্রাফ ও ডেটা। সেই ব্যবসা সফলতা দেয়নি বিল গেটসকে। বলা যায়, একরকম বিপর্যয় ছিল তা। তবে এতে যে বিল গেটস ভেঙে পড়েননি, তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই ব্যর্থতাকে কোনো রকম মাথায় না নিয়েই দ্বিগুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করেন মাইক্রোসফট নামের নতুন প্রতিষ্ঠান। মাইক্রোসফট শুরু করার পর থেকে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

আরিয়ানা হাফিংটন

আরিয়ানা হাফিংটন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন ৩৬ বার

বর্তমান বিশ্বে অনলাইন প্রকাশনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্বীকৃত নামগুলোর একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য হাফিংটন পোস্ট। অথচ এটির প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ানা হাফিংটনের ব্যর্থতার ইতিহাস যেন এক করুণ কাহিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিন ডজন প্রকাশকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। ৩৬ জন প্রকাশকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর হাফিংটনের দ্বিতীয় বইটি প্রকাশিত হয়। এমনকি হাফিংটন পোস্ট যখন চালু হয়, তখন সেটি নিয়েও ছিল ডজন ডজন নেতিবাচক পর্যালোচনা। তা সত্ত্বেও দমে যাননি তিনি। তাতেই ব্যর্থতা কাটিয়ে সফল হাফিংটন। ৭১ বছর বয়সী আরিয়ানা হাফিংটন গ্রিক আমেরিকান লেখিকা। নিজে একসময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বামী মাইকেল হাফিংটনও ছিলেন রাজনীতিতে। পরে যুক্ত হন লেখালেখির সঙ্গে। নিয়মিত কলাম লিখতে থাকেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য হাফিংটন পোস্টের কল্যাণে। ২০১১ সালে দ্য হাফিংটন পোস্টকে অধিগ্রহণ করে আমেরিকান অনলাইন লিমিটেড (এওএল)। আর আরিয়ানা হাফিংটন দায়িত্ব নেন পোস্ট মিডিয়া গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও এডিটর ইন চিফ হিসেবে। বর্তমানে এ মিডিয়া গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত আছে ইএনগ্যাজেট, এওএল মিউজিকসহ আরও কয়েকটি সেবা।

ওয়াল্ট ডিজনি

সৃজনশীলতার অভাবে চাকরি খুইয়েছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি

ওয়াল্ট ডিজনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম অ্যানিমেশন প্রোগ্রামার। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ও সফল প্রযুক্তি ভাবনার অধিকারী তিনি। অথচ তিনিই কিনা ক্যারিয়ারের শুরুতে একটি সংবাদপত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তাঁকে শুনতে হয়েছিল, তাঁর নাকি সৃজনশীলতার অভাব রয়েছে। এরপর অধ্যবসায় দিয়ে ডিজনি তাঁর প্রথম অ্যানিমেশন কোম্পানি তৈরি করেন। যার নাম ছিল লাফ-ও-গ্রাম ফিল্ম। ওই কোম্পানির জন্য ১৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করেছিলেন। কয়েকজন কর্মীও নিয়োগ দেন। পিক্টোরিয়াল ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে রূপকথার কার্টুনের একটি সিরিজও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে পিক্টোরিয়াল ফিল্মস দেউলিয়া হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় লাফ-ও-গ্রাম ফিল্মসও। আবার ব্যর্থতা। তবে পিছিয়ে পড়েননি। হতাশ না হয়ে হলিউডেই সফলতার পথ খুঁজে নেন ডিজনি। এরপরের জীবন শুধুই সফলতার গল্প।

স্টিভ জবস

নিজের কোম্পানি থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল স্টিভ জবসকে

একটি ছোট গ্যারেজেই অ্যাপল শুরু করেছিলেন স্টিভ জবস আর স্টিভ ওজনিয়াক, ১৯৭৬ সালে। ২১ বছর বয়স ছিল তখন স্টিভ জবসের। মাত্র ২ বছরের মাথায়, অর্থাৎ ২৩ বছর বয়সেই হয়ে গিয়েছিলেন মিলিয়নিয়ার। তবে নিজের হাতে গড়া এই কোম্পানি থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ১৯৮৪ সালে ম্যাকিনটোশ কোম্পানি বাজারে আনে অ্যাপল। স্টিভ জবসের নেতৃত্বেই সেটি আসে। কিন্তু বাজারে আসার আগে যত সাড়া ফেলেছিল, সেই বিবেচনায় আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। আর সেই ব্যর্থতার দায় স্টিভ জবসের ওপর চাপান অ্যাপলের তৎকালীন সিইও জন স্কুলি। এরপর নিজের কোম্পানি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় স্টিভ জবসকে। নেক্সট নামে নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন জবস। পরে যা অ্যাপল অধিগ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকে আবার অ্যাপলে ফিরে আসেন জবস। নিজের উদ্ভাবনী দক্ষতায় অ্যাপল ব্র্যান্ডকে নিয়ে যান নতুন উচ্চতায়।

মিল্টন হারশে

তিন কোম্পানির ব্যর্থতার পর সফল মিল্টন হারশে

বিখ্যাত মার্কিন কোম্পানি হারশের চকলেট পছন্দ করে না, এমন মানুষ খুব কমই আছে। তবে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন হারশে একদম শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। একটি প্রিন্টার কোম্পানিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে বরখাস্তও হন। এরপর হারশে তিনটি আলাদা আলাদা ক্যান্ডি তৈরির কোম্পানি শুরু করেছিলেন। যার সব কটিই ব্যর্থ হয়। একদম শেষ প্রচেষ্টায় হারশে ক্যারামেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তাতেই দেখা পান সফলতার। পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি হারশেকে।