অর্থনীতির গেম চেঞ্জার–৪৫

বাদশা মিয়া: শূন্য থেকে বস্ত্র খাতের ‘বাদশা’

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে পকেটে ১০ টাকা নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের গদিতে ওঠেন। কয়েক দিন পর রব ভূইয়া নামের গদি থেকে এক বান্ডিল সুতা (১০ পাউন্ড) বাকিতে কিনে এক ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। তাতে মুনাফা হয় চার টাকা। এভাবেই এক দোকানের সুতা অন্য দোকান বা ক্রেতার কাছে বিক্রি করে কমিশন মিলত। ধীরে ধীরে সুতার সঙ্গে নিজের জীবনকে বেঁধে ফেলেন। সেই সুতাই মাদারীপুরের শিবচরের বাদশা মিয়াকে আজ বস্ত্র খাতের অলিখিত বাদশা হিসেবে গড়ে তুলেছে।

নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে গত ৪৭ বছরে বস্ত্র খাতের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের একজন হয়েছেন বাদশা মিয়া। প্রতিষ্ঠা করেছেন বাদশা টেক্সটাইল, কামাল ইয়ার্ন, পাইওনিয়ার নিটওয়্যার ও পাইওনিয়ার ডেনিম নামে চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ময়মনসিংহের ভালুকা ও হবিগঞ্জে বাদশা মিয়ার চার কারখানায় কাজ করেন ২৫ হাজারের বেশি কর্মী। বার্ষিক লেনদেন ৪০ কোটি ডলারের বেশি, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানি অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা। টানা কয়েকবার রপ্তানি ট্রফি পেয়েছে বাদশা টেক্সটাইল ও কামাল ইয়ার্ন।

যেভাবে ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন

১৯৭৫ সালে ১৪ বছর বয়সে টানবাজারে আসেন বাদশা মিয়া। দ্রুত তিনি ব্যবসায় দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। তখন সুতা বেচাকেনায় দালালি প্রথা ছিল। এক দোকানের সুতা অন্য দোকান বা ক্রেতার কাছে বিক্রি করে কমিশন মিলত। এক বেল সুতা (৪৮০ পাউন্ড) বিক্রি করলে সাত টাকার মতো আয় হতো। প্রথম দিকে সুতার দালালি করে ভালোই উপার্জন করেন তিনি।

গত বছর প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বাদশা মিয়া বলেন, শুরুর দিকে আমার টাকাপয়সা ছিল না। গাজীপুরের কাশেম কটন মিলের নির্বাহী পরিচালক মঈনুল ইসলাম সাহেব আমাকে স্নেহ করতেন। ১-২ বেল সুতা আমার নামে বরাদ্দ দিতেন। সেই সুতা জয়দেবপুর পর্যন্ত গরুর গাড়িতে করে এনে বাসে ওঠাতাম। তারপর ফুলবাড়িয়া স্টেশনে আসার পর আরেক বাসে উঠে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছাতাম। এভাবে বেশ কিছুদিন ব্যবসা করেছি।

১৯৭৬ সালে পাইকারি সুতা বিক্রির লাইসেন্স করেন বাদশা মিয়া। টানবাজারে ভাড়ায় গদি নেন এবং কয়েক মাসের ব্যবধানে ভালো লোকেশনে সেটিকে স্থানান্তর করেন। তখন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) আশরাফ, জিনাত, মন্নু, অলিম্পিয়া, কাদরিয়াসহ কয়েকটি বস্ত্রকল থেকে সরাসরি সুতা কিনে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিক্রি শুরু করেন। বিভিন্ন হাটেও সুতা বিক্রি করেছেন। বাদশা মিয়া বলেন, টেক্সটাইল মিল থেকে সুতা নিয়ে সরাসরি হাটে হাটে দৌড়াতাম। আবার অনেক সময় রাতের বাসে চড়ে বিভিন্ন জেলার বস্ত্রকলে চলে যেতাম। পরদিন সুতাভর্তি ট্রাক নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ফিরতাম।
সুতার ব্যবসা করে ১৯৮২ সালের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যান বাদশা মিয়া। ১৯৮৩ সালে একসঙ্গে ৪-৫টি বস্ত্রকলের সুতা বিক্রির একক এজেন্ট হন। তখন একেকটি মিলে এজেন্ট হতে ৫০ লাখ টাকা জামানত দিতে হতো। এজেন্ট হওয়ার পর ব্যবসা আরও দ্রুত বাড়তে থাকে তাঁর।

রাজধানীর বাড্ডায় নিজের প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে বাদশা গ্রুপের কর্ণধার মো. বাদশা মিয়া

নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটীতে জমিও কেনেন। ১৯৮৬ সালে নিজের সেই জমিতে পোশাক কারখানা করার পরিকল্পনা করেন বাদশা মিয়া। মেশিনপত্রও কিনে আনেন। তবে শেষ মুহূর্তে কারখানা করার পরিকল্পনা থেকে সরে এলেন। মেশিনপত্র দিলেন বিক্রি করে। আবার দোকানদারিতে মনোযোগ দিলেন। অবশ্য সেখানে টুস্টিং কারখানা মানে সুতা ডাবলিং বা মোটা করার কারখানা দেন। চাদর বুনতে তখন টুস্টিং সুতার ছিল বেশ কদর।

বাদশা মিয়া ভাইদের নিজের ব্যবসায় নিয়ে আসেন। পরের বছর ভারত থেকে তুলা আমদানি শুরু করেন। অবশ্য তার আগে সুতা আমদানিতে হাত পাকান বাদশা মিয়া। ধীরে ধীরে টানবাজারের ‘বাদশা’ অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন বাদশা মিয়া। আসমা বেগমকে বিয়ে করেন। তার আগেই নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় নিজের বাড়ি নির্মাণ হয়ে গেছে। টানা দুবার টানবাজারের সুতা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

অবশেষে করলেন কারখানা

স্কয়ার টেক্সটাইলে প্রথম থেকেই সুতার এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করেন বাদশা মিয়া। তার সূত্র ধরেই ১৯৯৭ সালে ঢাকায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। ১৯৯৯ সালে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটীতে ৪০০ মেশিন দিয়ে সোয়েটার কারখানা করেন। ১০ বছর পর সেটিকেই ভালুকায় স্থানান্তরিত করেন। বর্তমানে কারখানায় মেশিনের সংখ্যা ২ হাজার। কাজ করেন ১৫ হাজার শ্রমিক।

সুতার ব্যবসায় হাত পাকিয়ে বস্ত্রকল করার আগে পোশাকশিল্পে আসার পেছনের কারণ বললেন বাদশা মিয়া। সেটি শুনুন তাঁর মুখেই, ‘পোশাক খাতের সংযোগ শিল্পে ধীরে ধীরে মুনাফা কমে আসতে থাকে। তা ছাড়া পোশাক কারখানার মালিকেরা অধিকাংশই সুতার দাম সময়মতো পরিশোধ করতেন না। সে জন্য একরকম জিদ করেই পোশাক কারখানা করে ফেলি।’

পোশাক কারখানায় সফল হওয়ার পর বস্ত্রকল করার দিকে মনোযোগ দিলেন বাদশা মিয়া। ভালুকায় ১০০ বিঘা জমির ওপর বস্ত্রকল শুরু করেন ২০০৩ সালে। ধীরে ধীরে সেটি বড় হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে হবিগঞ্জে আড়াই শ বিঘা জমির ওপর ডেনিম কাপড় উৎপাদনের কারখানা করেন। সেখানে তাঁর বিনিয়োগ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

পোশাকের মতো বস্ত্রকলে বিনিয়োগ করার পেছনেও গল্প আছে। বাদশা মিয়া বলেন, ‘ব্যবসা করতে গিয়ে দেখলাম আমরা সুতা বেচে পাই ২ আনা, আর মিলমালিকেরা পান ২ টাকা। তা ছাড়া তখনকার সময়ের সব কটি টেক্সটাইল মিলে ঘুরেছি। তুলা থেকে সুতা উৎপাদনের প্রতিটি স্তর আমার প্রায় মুখস্থ।’...তবে আসল কারণটা বললেন অনেক পরে, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল শিল্প গড়ব। সেখানে অনেক লোক কাজ করবেন। আমি সব সময়ই আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। সৃষ্টিকর্তার দয়া আর আমার পরিশ্রম সেটিকে এক সুতায় গেঁথে দিয়েছে।’

রাজধানীর বাড্ডায় নিজের প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে বাদশা গ্রুপের কর্ণধার মো. বাদশা মিয়া

সাদামাটা জীবন

বাদশা মিয়া ৬১ বছর বয়সে এসেও দিনে ১৬ ঘণ্টার মতো কাজ করেন। রাতে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা ঘুমান। প্রায়ই মাঝরাতে ভালুকা বা হবিগঞ্জে চলে যান। সুতা ও ডেনিম কারখানায় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই উৎপাদন হয়। পুরো কারখানা চক্কর দেন। উৎপাদন দেখেন। তারপর ঘুমাতে যান।

বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমি হলাম কামলা (খেটে খাওয়া) মানুষ। কারখানায় কাজ করতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই দিনের জন্য হলেও ভালুকা বা হবিগঞ্জে কারখানায় গিয়ে থাকি।’ অবসরে কী করেন—জানতে চাইলে বলেন, ‘অবসরেও কাজ করতে পছন্দ করি। ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে গেলেও দেশেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’

কারখানার আশপাশে শাকসবজি ও ফলমূলের চাষ করেন বাদশা মিয়া। কারখানার কাজের ফাঁকে সেখানে সময় কাটান। তাঁর ইচ্ছা, ছেলেদের হাতে ব্যবসার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চাষবাসে মনোযোগ দেবেন। ইতিমধ্যে পড়াশোনা শেষ করে তাঁর গড়ে তোলা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন দুই ছেলে কামাল উদ্দিন আহমেদ ও মহিউদ্দিন আহমেদ।

বাদশা মিয়ার কাছে জানতে চাই, আপনার জীবনে কী কোনো অতৃপ্তি আছে? বললেন, ‘বাবার কাপড়ের ব্যবসা ছিল। আমাদের বাড়িতে তাঁত ছিল। ফলে ছোটবেলা থেকেই সুতা ও কাপড়ের সঙ্গে সম্পর্ক। স্বাধীনতার পর আমরা আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে যাই। সে কারণেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ আসতে হয়েছিল।’

বাদশা মিয়া বলেন, ‘আসছি কোথা থেকে? অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে শিল্পকারখানা করেছি। হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজির ব্যবস্থা করেছি। আজকের পর্যায়ে আসার পর আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। আর কী অতৃপ্তি থাকতে পারে, আপনিই বলেন।’