বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
ব্যবসার কাজে ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিলেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধা। হোটেলে সকালে কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছিলেন। একটি সংবাদের ওপর নজর পড়ল তাঁর—দেশটিতে দ্বিতীয় পরিবেশবান্ধব কারখানা উদ্বোধন হচ্ছে। আর সেটি নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।
মুহূর্তের মধ্যে সাজ্জাদুর রহমান মৃধা সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশে এমন পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণ করবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পড়লেন তিনি। পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণের সঙ্গে জড়িত একজন কনসালট্যান্ট বা পরামর্শক খুঁজে বের করলেন তিনি।
সাজ্জাদুর রহমান মৃধা শ্রীলঙ্কার সেই পরামর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারখানা পরিদর্শনের অনুমতি চাইলেন। তবে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিল না। তারপরও তিনি দমলেন না। পরিচয় গোপন রেখে কৌশলে তিনি কারখানাটি ঘুরে এলেন। তারপর ফিরে এলেন দেশে। দেশে ফিরেই সাজ্জাদুর রহমান কারখানার জন্য জায়গা খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যাটে-বলে হচ্ছিল না। তখন ছিল দেশজুড়ে গ্যাস–সংকট। গ্যাসের নতুন সংযোগ পাওয়া তখন মোটামুটি হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরদীর ইপিজেড কর্তৃপক্ষ জমির সঙ্গে গ্যাস–সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকার সাভারের আশুলিয়া ও গাজীপুরে অধিকাংশ পোশাক কারখানা। সেখান থেকে এত দূরে কারখানা করলে শ্রমিক পাওয়া যাবে কি না, সেই দুশ্চিন্তাও রয়েছে। সব সুযোগ-সুবিধা একবারে মিলবে না, ফলে চ্যালেঞ্জ নিলেন সাজ্জাদুর রহমান মৃধা। ঈশ্বরদীতেই পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন।
সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরেই ২০১২ সালে সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানার জগতে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। তাঁর প্রতিষ্ঠান ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা। সেই থেকে শুরু। এরপর বাংলাদেশে একে একে গড়ে উঠতে থাকে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫০টির বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পোশাক ও বস্ত্র কারখানাই বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দেয়। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন’। সনদটি পেতে প্রতিটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গ্লোড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ ও ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে। বাংলাদেশের প্রায় সব কটি পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্র কারখানা ইউএসজিবিসির লিড সনদপ্রাপ্ত। শিপইয়ার্ড, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরিরও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বস্ত্র ও পোশাক খাতে ১৫০টি পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনের মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। তার মধ্যে ৪৪টি লিড প্লাটিনাম, ৯৩টি লিড গ্লোড, ৯ লিড সিলভার এবং ৪টি লিড সার্টিফায়েড কারখানা রয়েছে।
পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনের সুফল দেশ-বিদেশে দুই দিকেই মিলছে। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব কারখানায় পোশাক তৈরিতে আগ্রহ বেশি দেখাচ্ছে। তাতে পোশাকের ক্রয়াদেশ ও বাড়তি মূল্য পেতে দর-কষাকষিতে কিছুটা এগিয়ে থাকছেন এসব কারখানার উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব কারখানায় বিদ্যুৎ ও পানির সাশ্রয় হওয়ায় পরিবেশের ওপর চাপ কম পড়ছে। শ্রমিকেরা কাজের ভালো পরিবেশ পাচ্ছেন। তাতে বহিবি৴শ্বে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে।
আবার ফেরা যাক সাজ্জাদুর রহমান মৃধার কথায়। আসুন তাঁর ব্যবসা শুরুর গল্পটা জেনে নিই। তিন দশক আগের কথা। পড়াশোনা শেষ করে সবে বড় ভাইয়ের পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছেন সাজ্জাদুর রহমান। শুরু করলেন কঠোর পরিশ্রম। তারপরও কাজের কাজ হচ্ছিল না। রাগ করে দিলেন চাকরিটা ছেড়ে। তারপর পরিচিত বিদেশি এক কূটনীতিকের পরামর্শে দিলেন বায়িং হাউস। পরপর তিনটি ক্রয়াদেশও এল। তবে একটি ক্রয়াদেশের পণ্যও ঠিকঠাক মতো দিতে পারলেন না। ক্রয়াদেশ বাতিল হলো। বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনলেন। ঋণে জর্জরিত হলেন। তারপরও আত্মবিশ্বাস হারালেন না। পরে ঠিকই ঘুরে দাঁড়ালেন।
সেই সাজ্জাদুর রহমান মৃধা প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে আজ দেশের একজন সফল উদ্যোক্তা। শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের একজন। সব মিলিয়ে সাজ্জাদুর রহমান মৃধার অ্যাবা গ্রুপে কর্মী সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১২ হাজার। তাঁদের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকার কাছাকাছি।
ইউএসজিবিসির লিড প্লাটিনাম সনদ পাওয়া ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও ছিল সাজ্জাদুর রহমান মৃধার সপ্তম কারখানা। তবে বর্তমানে তাঁর কারখানা পাঁচটি। গাজীপুরের মাওনায় বাকি চারটি কারখানাই ইউএসজিবিসির লিড গোল্ড সনদ পাওয়া।
গত অক্টোবরে সাজ্জাদুর রহমান মৃধার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেই আলোচনায় ছিলেন আরেক পরিবেশবান্ধব কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক। সেই আলাপচারিতায় সাজ্জাদুর রহমান মৃধা শোনান তাঁর উঠে আসার গল্প। পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণের পেছনের ঘটনা।
ঈশ্বরদীতে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও কারখানা নির্মাণের আগে শ্রমিক পাওয়া যাবে কিনা, সেই দুশ্চিন্তা থাকলেও পরে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। বরং অদ্ভুত এক সমস্যা তৈরি হলো। সাজ্জাদুর রহমান মৃধা বলেন, ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আবেদন এল। এমনকি অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ আসতে লাগল। তখন মানবসম্পদ ও প্রশাসন প্রধানকে চাকরিচ্যুত করে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনা হয়। বর্তমানে কারখানাটিতে কর্মরত শ্রমিক কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাস। মাস্টার্স পাসও শ্রমিক রয়েছেন।’
সাজ্জাদুর রহমান বললেন, দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। পুরো এলাকায় কারখানার কর্মীরা বিশেষ সম্মান পান। মুদিদোকান থেকে শুরু করে সেলুন পর্যন্ত কোনো দোকানে সেবা নিতে গেলে অগ্রাধিকার পান।
কেবল নিজের ব্যবসার লাভের দিকটা না দেখে পুরো শিল্পের চেহারা পরিবর্তনে যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, তাঁদের মধ্যে সাজ্জাদুর রহমান রয়েছেন। নিজে পরিবেশবান্ধব কারখানা করে চুপচাপ বসে থাকেননি। সাজ্জাদুর রহমান জানান, তিনি অন্যদের পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণে উৎসাহ দিয়েছেন। ২২-২৩টি পরিবেশবান্ধব কারখানার নকশা বিনা খরচায় করে দিয়েছেন।
পরিবেশবান্ধব কারখানা করেই থেমে নেই সাজ্জাদুর রহমান মৃধা। তিনি ডেনিমের ওয়াশিং নিয়েও গবেষণা করছেন। তাঁর ভাষ্য, ডেনিমের ওয়াশিংয়ে প্রচুর পানি খরচ হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে রাসায়নিকও খরচ হয়। ওই পানি ও রাসায়নিক ব্যয় কমিয়ে আনার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। বর্তমানে ওয়াশিংয়ে যে পানি ব্যবহার করা হয়, তার ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনার পাশাপাশি রাসায়নিকের সাশ্রয় হবে।
সাজ্জাদুর রহমান মৃধা সব সময়ই নতুন কিছু করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। তাঁর মতো পরিশ্রমী উদ্যোক্তাদের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য টেকসই হওয়ার পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। জয়তু সাজ্জাদুর রহমান মৃধা।