সহকর্মীদের সঙ্গে জায়ান্ট মার্কেটার্সের উদ্যোক্তা মাসুম বিল্লাহ (ডানে বসা)
সহকর্মীদের সঙ্গে জায়ান্ট মার্কেটার্সের উদ্যোক্তা মাসুম বিল্লাহ (ডানে বসা)

কুমিল্লায় বসে ৫২টি দেশে মাসুমের তথ্যপ্রযুক্তি সেবা

কলেজে পড়ার সময় আমার বাবার পোস্টিং ছিল কুমিল্লাতে। তাই মাঝেমধ্যে এই শান্ত নিরিবিলি শহরে যাওয়া হতো। এরপর গণিত উৎসব ও অন্যান্য আয়োজনের সুবাদে প্রায়ই এই শহরে গিয়েছি। যদিও ধীরে ধীরে এটি কোলাহলপূর্ণ ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হয়েছে। রাস্তাজুড়ে অটো আর ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিক্য। সব মিলিয়ে কুমিল্লাও এখন জ্যামের শহর। কাজেই সেদিন ঝাউতলাতে যাওয়ার জন্য হাঁটারই সিদ্ধান্ত ছিল।

চারতলার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ক্লান্তি হাওয়া হয়ে গেল। ভেবেছিলাম, আইটি সেবা প্রতিষ্ঠানে ঢুকেই দেখব, সারি সারি কম্পিউটারের পেছনে কর্মীরা মহাব্যস্ত। তবে দেখলাম, ঢুকতেই একটা ‘ড্রয়িংরুম’ ব্যাপার। মাটিতে বসার আয়োজন, বিন ব্যাগ আর টুল। দুই পাশে বইয়ের র ্যাকে অনেক বই। নিজের বই দেখে মন আরও ভালো হলো। সেটি পেরিয়ে একটি টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা! চমৎকার করে সাজানো বাঁ দিকের দেয়ালে লোগোর নিচে একটি লোহার বাইসাইকেল! পাশে দুটি কাচঘেরা কক্ষ। সেখানেই জায়ান্ট মার্কেটার্সের (https://giantmarketers.com/) দুই অংশীদার বসেন। তবে তাঁদের বেশির ভাগ সময়ই কর্মীদের ওখানে পাওয়া যায়। চারতলা আর পাঁচতলায় নিয়মিত অফিস করেন ৩০ জন কর্মী। পাঁচতলাতে খাবার ঘর। সেটিকে আবার মাঝেমধ্যে বড় পর্দায় সবাই মিলে খেলা দেখার আসর বানিয়ে ফেলা যায়।

একটু সুস্থির হয়ে মুখোমুখি হলাম জায়ান্ট মার্কেটার্সের উদ্যোক্তা মাসুম বিল্লাহর। বললেন, ‘অফিসটা আমিই নিজেই নকশা করেছি। উদ্দেশ্য, কর্মীদের চাঙা রাখা। কারণ, কাজ তো কম্পিউটারের পর্দার দিকে তাকিয়ে করতে হয়।’

১৫ বছর আগে ২০০৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনায় অনার্সের ছাত্র মাসুম বিল্লাহ ভূঁইয়া ভাগ্যান্বেষণে ও পড়াশোনার জন্য বিদেশ যাবেন বলে ঠিক করেন। বন্ধুরা সবাই চলে যাচ্ছেন। তবে মাসুমের বাসার কেউ রাজি হননি। সেই মাসুম এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া ও কেনিয়ার ১৩ জনের স্থায়ী কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর কয়েকজনের খণ্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা করেছেন কুমিল্লাতে বসেই। আর ২০১৬ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জায়ান্ট মার্কেটার্স বিশ্বব্যাপী সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেন বা এসইও এবং ডিজিটাল মার্কেটিং সেবা দিচ্ছে আমেরিকা, ইতালি, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ভারত, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, পোল্যান্ড, রাশিয়াসহ বিশ্বের ৫২টি দেশের গ্রাহকদের। তাদের মূল সেবা হলো এসইও। গুগল বা এ রকম কোনো সার্চ ইঞ্জিনে কোনো বিষয়ে অনুসন্ধান করলে ফলাফলে নিজের ওয়েবসাইট ওপরের দিকে দেখানোর জন্য ওয়েবসাইট ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ কিছু কাজ করতে হয়। জায়ান্ট মার্কেটার্স সফটওয়্যার, ই-কমার্স, সাস, ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ-সংক্রান্ত সব—যেমন কৌশল প্রণয়ন করা থেকে সেগুলো বাস্তবায়ন—সেবা দিয়ে থাকে। ফলে এসইও, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট ফর এসইও, ই-কমার্স, ওয়ার্ডপ্রেস সাইট ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট, অনলাইন মার্কেটিং ও কনসালটেন্সি, বিজনেস প্রমোশন এবং ডিজিটাল ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ তাদের করতে হয়।

অবশ্য মাসুমের শুরুটা মসৃণ ছিল না। বিদেশ যেতে না পারার দুঃখ মনে নিয়ে মাসুম উপলব্ধি করেন, শুধু অনার্স-মাস্টার্সে কাজ হবে না। দক্ষতা বাড়াতে হবে। ২০০১ সাল থেকে কম্পিউটার এবং ২০০৪ সাল থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ ছিল। নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ২০০৭ সালে ঢাকায় এসে বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন। ‘এর মধ্যে ওরাকল ডেটাবেইসের একটা কোর্স করতে গিয়ে টের পেলাম, বিজ্ঞানের ছাত্র না হওয়ায় অনেক কষ্ট হচ্ছে। সেটা বাদ দিলাম।’ ছোট ভাই মামুন বিল্লাহ সে সময় এসইও, ব্লগিং ইত্যাদি করতেন। তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে মাসুম এই খাতের সম্ভাবনা দেখতে শুরু করেন। বললেন, ‘সবচেয়ে ভালো লাগে, এখানে প্রতিদিনই শেখার অবকাশ আছে।’ গুগলের ব্লগস্পটে একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে অ্যাডসেন্সের অ্যাকাউন্ট করেন মাসুম। প্রথম আয় হয় ১৬ মার্কিন ডলার। তারপর ২৪ ডলার। ৬ মাসের মধ্যে মোটামুটি একটি স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়।

এমন সময় কুমিল্লায় গিয়ে অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন মাসুম। পরিবারের চাপে একটি চাকরি নেন ব্রোকার হাউসে। অফিস মতিঝিলে। আর এমবিএ করতে ভর্তি হলেন বনানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারা দিন অফিস করে বিকেল এমবিএর ক্লাস করাটা প্রতিনিয়ত কঠিন হতে থাকে। কাজেই, একসময় চাকরি ছেড়ে দেন। কুমিল্লাতে ভর্তি হন বিজনেস স্টাডিজে। আর রাত জেগে চলতে থাকে নিজের দক্ষতার উন্নয়ন। এই সময়ে ঢাকার ওপর মন উঠতে শুরু করে। ‘এই জ্যামের শহরে আর থাকব না। সময়মতো চলে যাব নিজের শহরে,’ হাসতে হাসতে বললেন মাসুম। যোগ করলেন, ‘এখন এখানেও অনেক জ্যাম।’

২০১১ সালে এমবিএ ও এমবিএস—দুটিই শেষ হয়। পড়ালেখা ছাড়া বাকি সময় ছিল নিজেকে তৈরি করার। ব্লগিংয়ের পাশাপাশি এসইওর ওপর আরও বেশি দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ নেন ডেভসটিমে। বললেন, ‘আমি ভাবতে থাকি, অনলাইনকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া যায় কি না। সে সময় দেশে অনলাইন কাজের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। বন্ধুবান্ধবেরা তো “বিয়ে করতে পারবি না” বলে খেপাত।’

২০১৩ সালে আবার চাকরিতে যোগ দেন মাসুম। এবারের অফিস সাভারে। বেতন মাত্র ৭ হাজার টাকা। অথচ রাতে ব্লগিং আর এসইওর কাজ করে তখনই সেই বেতনের কয়েক গুণ বেশি টাকা উপার্জন করেন। অফিসের পরিবেশ খুবই খারাপ। তাই চাকরি ছাড়লেন।

মাসুম বললেন, ‘এ সময় অনেকে আমাকে কোনো একটা স্কুলে আইসিটি শিক্ষকের চাকরি নিয়ে থিতু হওয়ার পরামর্শ দেন। আমি ভেবেছি, আমি এটির শেষ দেখে ছাড়ব।’ ২০১৪ সালের শেষের দিকে ফ্রি ল্যাংন্সিং সাইট ই-ল্যান্সে কাজ শুরু করে অচিরেই ভালো র​্যাঙ্কিংয়ে চলে যান। একজন বায়ার তাঁকে হাজার ডলারের জব অফার করলে সেটা লুফে নেন। তারপর নিজের শহর কুমিল্লায় চলে আসেন মাসুম।

নিজের চাকরির পাশাপাশি শুরু হয় কুমিল্লার এসইও আর্মি গড়ার কাজ। বললেন, ‘সবাই ঢাকাতে বা বিদেশে চলে যেতে চায়। কারণ, কুমিল্লাতে এ ধরনের কাজের সুযোগ নেই। ফলে সেখানে কোনো দক্ষ লোক নেই। তাই আমি আগ্রহীদের তৈরি করতে শুরু করি। আমাদের বাসার নিচতলাতে কাজটি শুরু করলাম।’

এভাবে ধীরে ধীরে কয়েকজনের টিম গড়ে ওঠে। ২০১৬ সালে নিবন্ধিত হয় জায়ান্ট মার্কেটার্স। দুই বছর পর নাজমুল হাসান ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে যুক্ত হন। ছয়জন কর্মী আর ঝাউতলায় ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের অফিস নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। অচিরেই আরও ৩ হাজার বর্গফুটের বড় জায়গা যুক্ত হওয়ায় অফিসের পরিসর বাড়ে। পূর্ণকালীন কর্মীর সংখ্যা হয় ২৫।

২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে জায়ান্ট মার্কেটার্সের নিজস্ব ক্যাম্পাস ও সেখানে ১০০ জন কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়তে চান মাসুম বিল্লাহ। ফেরার সময় পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘২০১৪ সালেই খাদিজা আক্তারকে বিয়ে করি। দুই মেয়ে রুমাইশা নাওয়ার ভূঁইয়া ও রুবাইয়া নাওয়ার ভূঁইয়াকে নিয়ে অফিসের কাছে রেসকোর্সে থাকি।’