করোনাকালের ঈদ

ঈদ তখন মাটি হয়ে যায়

করোনাকাল বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা গেছে থমকে। উৎসবের আনন্দও ম্লান হয়ে গেছে করোনার থাবায়। তবু ঈদ আসে, আসে উৎসব। অনেকে বড়বেলায় ঈদের আনন্দ খোঁজেন ফেলে আসা ছোটবেলার ঈদে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দা। তাই শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা সংকটের মধ্যে তৃতীয় ঈদ উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে কয়েক দিন পর। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, প্রধান নির্বাহী ও ব্যাংকারদের ঈদের একাল-সেকাল নিয়ে এবারের মূল আয়োজন।

এ কে আজাদ সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
 এ কে আজাদ সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই

ঈদ মানে শুধু আনন্দ নয়, ঈদ মানে এক অনির্বচনীয় আনন্দ। অনেক আনন্দই ম্লান হয়, হয় না শুধু ঈদের আনন্দ। একটু পেছনের দিকে যদি ফিরে যাই, ছোটবেলায় ঈদ আসার আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকত যে ঈদে কী কী করব, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাব। নতুন জামা পরে ফুরফুরা মেজাজে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরির মজাই ঈদের মজাটা বাড়িয়ে দিত। কে কয়টা জামা পেল—এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো।

বড় হওয়ার পর ঈদের মজা কি তাহলে কমে গেছে? না, পুরোপুরি কমেনি। মজাটা আছেই। তবে ধরনটা পাল্টেছে। আগে পেতে ভালো লাগত, এখন দিতে ভালো লাগে। এখন তো দায়িত্বটা বড়। এ দায়িত্ব শুরু হয়ে যায় ঈদের আগে থেকেই। মূল দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠিকঠাক বেতন-মজুরি, বোনাস ইত্যাদি দেওয়া। এটা করতে পারলে আনন্দ পাই।

এবারেরটিসহ তিনটি ঈদ পড়ল করোনায়। তাতে স্বাভাবিক ঈদের নামাজ ব্যাহত হয়েছে। কোলাকুলি করা যায়নি। আড্ডা, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়াসহ ঈদের অনেক আনুষ্ঠানিকতা করা যায়নি। এই এক বছরে আমরা কতজনকে যে হারালাম! এটা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঈদে তাদের সঙ্গে দেখা হতো, ফোনে কথা হতো। তবে এই করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। যেমন অনেক কিছু আমরা সেরে ফেলছি এখন অনলাইনে। জুম বৈঠক করে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তও নিচ্ছি।

একটি দেশ যখন আরেকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তখন একটি বিপদ একটি দেশে এলে অন্য দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর করোনা তো ব্যতিক্রম ছাড়া মোটা দাগে গোটা বিশ্বের মানুষের জন্যই অভিশাপ হিসেবে এসেছে।

আগে একধরনের রুটিনমাফিক চলতাম। সময়ের খুব গুরুত্ব দিতাম না। এখন বাস্তবতার কারণেই সময় ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হচ্ছে। কত সময় ধরে বৈঠক, কত সময় বাইরে থাকা, কখন ঘরে ফিরে আসা—সব এখন শৃঙ্খলাবদ্ধ। ভয়, আত্মরক্ষা ইত্যাদি কারণেই তা মানতে হচ্ছে। সবার জন্য ভ্যাকসিনটা হয়ে গেলে ভয়টা কেটে যেত। তখন একটু বের হওয়া যেত। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা চলছে। তৃতীয় ধাক্কাও কিন্তু আসতে পারে। ভ্যাকসিন পাওয়া যাবেন—তার ওপর নির্ভর করে থাকলে তো চলবে না। তৃতীয় ধাক্কার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। নিজেরা তো সচেতন থাকবই, রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতিও জরুরি।

ব্যবসা–বাণিজ্যের কথায় যদি একটু আসি। একটি দেশ যখন আরেকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তখন একটি বিপদ একটি দেশে এলে অন্য দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর করোনা তো ব্যতিক্রম ছাড়া মোটা দাগে গোটা বিশ্বের মানুষের জন্যই অভিশাপ হিসেবে এসেছে। করোনার কারণে গত অর্থবছরে আমাদের ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল। গত অর্থবছরে ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মূল বাজার। মাত্র ১০ শতাংশ রপ্তানি করি ইউরোপে। মাঝখানে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা কিছুটা বাড়ায় আশা করছি, চলতি অর্থবছর শেষে আমাদের গ্রুপের ব্যবসা হবে ৬০ কোটি ডলার।

মোটা দাগে বললে বলা যায়, এগুলোও আমাদের ঈদের আনন্দ। নিজের গ্রুপের জন্য, দেশের জন্য ভালো কোনো খবর মনে আনন্দ জোগায়। করোনায় অনেক নিম্নবিত্ত মানুষ কষ্টে আছে। হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে তাদের সাহায্য করছি। নগদ সহায়তা দিচ্ছি, ত্রাণও পৌঁছে দিচ্ছি। এই বিষয়গুলোও মনকে স্বস্তি দেয়। তবে অনেক নিম্নবিত্ত এখনো সাহায্য-সহযোগিতার বাইরে। বুঝতে পারি। এটা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঈদ তখন মাটি হয়ে যায়।