রমজানে যশোরে ঈদের বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। জমে উঠেছে থানকাপড়ের ব্যবসা। বিশেষ করে মেয়েদের থ্রি-পিস এবং ছেলেদের শার্ট-প্যান্টের কাপড়ের দোকানের ভিড় চোখে পড়ার মতো
রমজানে যশোরে ঈদের বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। জমে উঠেছে থানকাপড়ের ব্যবসা। বিশেষ করে মেয়েদের থ্রি-পিস এবং ছেলেদের শার্ট-প্যান্টের কাপড়ের দোকানের ভিড় চোখে পড়ার মতো

ঈদ অর্থনীতি

ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে

  • শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, জামা, জুতা থেকে শুরু করে গাড়ির মতো বিলাসী পণ্যের ব্যবসা চাঙা।

  • ইলেকট্রনিক পণ্যের বিক্রি বাড়তি।

  • দেশীয় পর্যটন ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা।

ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত বিপণিবিতানে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কেনাকাটা চলছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে। জমজমাট কেনাকাটায় করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য আবারও পুরোদমে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাতে ব্যবসায়ীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন।

ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি কত হাজার কোটি টাকার, তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বড় এই উৎসবে শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, জামা, জুতা থেকে শুরু করে গাড়ির মতো বিলাসী পণ্যের ব্যবসা চাঙা হচ্ছে। একশ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বছর বছর এই অর্থনীতির আকারও বড় হচ্ছে। যদিও মহামারির কারণে ২০২০ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা তলানিতে নেমেছিল। গত বছর শেষ ২০ দিন ব্যবসা হলেও তাতে ব্যবসায়ীরা খুশি হতে পারেননি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনেছেন। পুঁজি হারিয়েছেন। তবে চলতি বছর ঈদের ব্যবসা ধারণার চেয়েও ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের চেয়ে বেচাবিক্রি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোটা সহজ হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা, এবারের ঈদে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।’

ঈদে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত মানুষ। পছন্দসই পোশাক কিনতে ক্রেতারা ভিড় করছেন দোকানে দোকানে

পোশাকের জমজমাট ব্যবসা

ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির বড় অংশজুড়ে পোশাকেরই রাজত্ব। চলতি বছর পয়লা বৈশাখ ও ঈদ কাছাকাছি হওয়ায় রোজার শুরু থেকেই ফুটপাত, ছোট-বড় কিংবা বিলাসবহুল বিপণিবিতান ও ফ্যাশন হাউসে বিক্রি শুরু হয়। ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়ে। শেষ দুই সপ্তাহ ধরে বিক্রেতারা ক্রেতাদের ভিড়ে দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না।

কয়েক বছর ধরেই ঈদের পোশাক কেনায় রাজধানীর ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন হাউসগুলো শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালের মতো বড় শহরগুলোতেও একই অবস্থা। সারা দেশে প্রায় ছয় হাজার ফ্যাশন হাউস ও বুটিক শপ রয়েছে।

দেশি পোশাকের ব্র্যান্ডের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে আড়ং। ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু করা ব্র্যান্ডটির বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বর্তমানে ২৫। বিক্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে পণ্য বিক্রি করছে তারা।

জানতে চাইলে আড়ংয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মোহাম্মদ আশরাফুল আলম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদে বিক্রি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক ভালো হয়েছে। গত মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) পর্যন্ত আমাদের প্রায় ২৫ লাখ পিস পোশাক বিক্রি হয়েছে।’ তিনি জানান, করোনার আগের ২০১৯ সালের তুলনায় এবারের ঈদে আড়ংয়ের পোশাকের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।

করোনার কারণে ২০২০ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা তলানিতে নেমেছিল। গত বছর শেষ ২০ দিন ব্যবসা হলেও তাতে ব্যবসায়ীরা খুশি হতে পারেননি।

ভালো সম্ভাবনা থাকায় তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পোশাকের দেশীয় ব্র্যান্ড গড়েছে। ব্যবসাও ভালো করছে। তেমনি একটি ব্র্যান্ড সারা লাইফস্টাইল। স্নোটেক্স গ্রুপের সহযোগী এই ব্র্যান্ডটির বিক্রয়কেন্দ্র বর্তমানে ৮।

জানতে চাইলে স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, রোজার প্রথম থেকেই ভালো বিক্রি হচ্ছে। শেষ সময়েও মধ্যরাত পর্যন্ত বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ক্রেতাদের পদচারণে মুখর থাকছে। তাতে ২০১৯ সালের চেয়ে তাঁদের পোশাক বিক্রি বেশি হয়েছে বলে জানান তিনি।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক টিম গ্রুপের দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ড হচ্ছে টুয়েলভ। গত এক বছরে নতুন করে ১৪টি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে তারা। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের ৩২টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।

টুয়েলভের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার পর স্বাভাবিক সময়ে ঈদ হওয়ায় পোশাকের ব্যবসা বড় উত্থানের প্রত্যাশা ছিল আমাদের। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। ২০১৯ সালে আমাদের যেসব বিক্রয়কেন্দ্র ছিল, সেখানে চলতি বছর বিক্রি বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ।’

গত কয়েক দিন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড, ধানমন্ডি, বনানী, পুলিশ প্লাজা ও বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায়, ইফতার ছাড়া অন্য সময় দোকানগুলোতে ক্রেতাদের কমবেশি ভিড় থাকছেই। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের সংঘর্ষের পর সেখানকার ব্যবসা আবার মোটামুটি জমে উঠেছে।

ফুটপাতের দোকানগুলোতেও নিম্ন আয়ের মানুষ ভিড় করেছেন। নিজেদের সাধ্যমতো কেনাকাটাও করছেন। রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় গত বুধবার ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাসির হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। রাত তখন সাড়ে ১০টা। ব্যবসা কেমন জানতে চাইলে হাসি দিয়ে নাসির বলেন, ‘ভালোই। খারাপ না। এই ধরেন দিনে ১৫-২০ হাজার টাকার বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে।’

জুতার বাজারও চাঙা

ঈদে পোশাকের পরই জুতার চাহিদা শীর্ষে। মূলত পোশাক কেনার পর ক্রেতারা জুতার দোকানে ভিড় করেন। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ও এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানগুলোতে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে জমজমাট কেনাকাটা হতে দেখা যায়।

নিম্ন আয়ের মানুষ পুরোপুরি ঈদ উৎসবে অংশ নিতে পারলে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি আরও চাঙা হতে পারত।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

জুতার একাধিক ব্র্যান্ডের কর্মকর্তারা জানান, গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর ঈদে বেশি জুতা বিক্রি হচ্ছে। ঈদ মৌসুমে তাঁরা যে পরিমাণ জুতা বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তার অর্ধেকের বেশি চার-পাঁচ দিন আগেই পূরণ হয়েছে।

জুতার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড বাটা শু তাদের নিজস্ব ও ফ্র্যাঞ্চাইজি মিলিয়ে সারা দেশে ৩৩৬টি বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক আরফানুল হক জানান, করোনার আগের অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় এ বছরের বিক্রিতে এখন পর্যন্ত দুই অঙ্কের বেশি প্রবৃদ্ধি আছে। তিনি বলেন, গত ১০ বছরের মধ্যে যেকোনো ঈদের তুলনায় এবারের বিক্রি বেশি।

ইলেকট্রনিক পণ্যের বিক্রি বাড়তি

করোনার আগের কয়েক বছর ধরে টেলিভিশন, মুঠোফোন, রেফ্রিজারেটর শীতাতপনিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্রের ঈদকেন্দ্রিক বিক্রিবাট্টা বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ও মোতালিব প্লাজা ঘুরে শেষ সময়ে মুঠোফোনের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের আনাগোনা দেখা যায়।

স্যামসাং ও ইলেক্ট্রা ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারজাত করছে ইলেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মো. মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে এসি ও রেফ্রিজারেটর বিক্রি বেড়েছে। তার মধ্যে ২০১৯ সালের চেয়ে এসির বিক্রিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে। অন্যান্য বছর ঈদের আগে টিভি বিক্রি বাড়লেও এবার তা হয়নি।

আসবাব ব্যবসায় মন্দা

ঈদের আগে অনেকে ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব কেনেন। এ সময় ক্রেতা টানতে আসবাবের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যছাড় দেয়। ফলে বিক্রি বাড়ে। তবে পোশাক, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্যের তুলনায় আসবাবের বিক্রি আশানুরূপ বাড়েনি বলে জানালেন একাধিক ব্যবসায়ী।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘দুই বছর পর স্বাভাবিক সময়ে ঈদ হতে যাচ্ছে। তবে অন্যবারের মতো আসবাবের বিক্রি বাড়েনি। মনে হচ্ছে এখনো ক্রেতারা জামাকাপড় কেনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। আমরা এখনো আশায় বুক বেঁধে আছি, ঈদের আগের দু-তিন দিন আসবাবের ভালো বিক্রি হবে।’

পর্যটনের পালে হাওয়া

করোনার প্রথম বছর ভয়াবহ খারাপ সময় পার করেছেন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও ট্যুর অপারেটররা। গত বছর মোটামুটি ব্যবসা করলেও মহামারির প্রথমবারের ক্ষতি পোষাতে পারেননি পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে চলতি বছর দেশীয় পর্যটন ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা তাঁদের।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা, ঈদ মৌসুমে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ করবেন। অধিকাংশের গন্তব্য কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবন ও সিলেট। অন্য বছর উচ্চবিত্তরা বিদেশে গেলেও এবার নানা বিধিনিষেধের কারণে তাঁদের একটি অংশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রিসোর্টে যাবে। ফলে রিসোর্টগুলো ভালো বুকিং পেয়েছে। বিদেশের মধ্যে ভারতে যাবেন অনেকে। তবে বিধিনিষেধের কারণে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল ও সিঙ্গাপুরে যাওয়ার হার কম। সব মিলিয়ে ঈদে দেশের পর্যটন খাত নতুন প্রাণ পাবে।’

ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে উৎসবকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশই অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর। অধিকাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ পান না। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবসার পুঁজির জোগান দেন। ঈদের আগে ভালো ব্যবসা হওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা করোনার পর ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পাবেন।’

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। সে জন্য তাঁরা ঈদ উৎসবে পুরোদমে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি। নিম্ন আয়ের মানুষ পুরোপুরি ঈদ উৎসবে অংশ নিতে পারলে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি আরও চাঙা হতে পারত বলে মন্তব্য করেন তিনি।