গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
ডিজিটাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির পুরো কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে সরকারের সাত সংস্থাকে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংস্থাগুলো হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অনুরোধ করেছি, তারা যাতে নিজেদের আইনের ধারা লঙ্ঘনের বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখেমো. জাফরউদ্দীন, বাণিজ্যসচিব
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুছ সামাদ আল আজাদের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে গত রোববার এসব চিঠি পাঠানো হয়। ২৪ আগস্ট গঠিত এ কমিটি তার আগে গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দাখিল করে।
বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে অনেক বিষয় জড়িত, যেগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের বাইরে। আমরা তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অনুরোধ করেছি, তারা যাতে নিজেদের আইনের ধারা লঙ্ঘনের বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখে।’
দুদককে দেওয়া চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করাসহ নানা বিষয়ে ই-ভ্যালি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় এটি দুদক–সংশ্লিষ্ট। দুদক আইন ২০০৪–এর প্রযোজ্য ধারা ও বিধিবিধানের আলোকে কার্যক্রম গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য
■ ই–কমার্স প্ল্যাটফর্মে অস্বাভাবিক হারে অফার দেয় ই–ভ্যালি, যা ই–শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
■ প্রতারণা, জালিয়াতি ও সময় মতো পণ্য সরবরাহ না করাসহ নানা বিষয়ে ই–ভ্যালি জড়িত।
■ গ্রাহকেরা খুদে বার্তা, ই–মেইল এবং কল সেন্টারে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া মেলে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যবস্থা নিতে জননিরাপত্তা বিভাগকেও চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে অস্বাভাবিক হারে অফার দেয় ই-ভ্যালি, ই-শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া গ্রাহকেরা খুদে বার্তা (এসএমএস), ই-মেইল এবং কল সেন্টারে ই-ভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো সাড়া দেয় না। ই-ভ্যালি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলেও জানা যাচ্ছে।
এনবিআরকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ই-ভ্যালির মূল কোম্পানি ই-ভ্যালি ডট কম লিমিটেডের সংঘ স্মারক (এওএ) অনুযায়ী ২০১৮ সালে এর পরিশোধিত মূলধন ৫০ হাজার টাকা থাকলেও এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা ১ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এ বিষয়ে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের প্রযোজ্য ধারা ও বিধান অনুযায়ী তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে পাঠানো চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, অভিযোগ পর্যালোচনা করে তারা দেখেছে, ই-ভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্যের অর্ডার নিলেও প্রতিশ্রুত সময়ে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। মন্ত্রণালয় আরও জেনেছে, ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করার নিয়ম থাকলেও গ্রাহকেরা এক মাস, দুই মাসেও পণ্য বুঝে পাচ্ছেন না। আবার ক্রেতারা অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলেও পণ্যের অর্ডার বাতিল করে পণ্যটি স্টকে নেই বলে জানিয়ে দেয় ই-ভ্যালি। পরে ক্যাশব্যাকের টাকা ই-ভ্যালির ওয়ালেটে যুক্ত করে দেওয়া হয়, যা দিয়ে শুধু ই-ভ্যালি থেকেই কেনাকাটা করা যায়। এ ছাড়া ক্রেতাদের কাছে সঠিক পণ্য সরবরাহ করা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। অধিদপ্তরকে এ নিয়ে তদন্ত করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।
তদন্তের পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে চিঠি দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ই-ভ্যালি নজরকাড়া অফার দিয়ে থাকে, যেমন ৩০০, ২০০ এবং ১০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক। এসব লোভনীয় অফারের কারণে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সুস্থ চর্চা ব্যাহত হয়েছে।
এ ছাড়া মানি লন্ডারিং–সম্পর্কিত কিছু আছে কি না, তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ তদন্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।
গত রাতে যোগাযোগ করলে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, তিনি চিঠি পেয়েছেন এবং কাজ শুরু করছেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহাও একই কথা বলেন।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট ই-ভ্যালি এবং এর চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেলের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে বিএফআইইউ। ২৬ আগস্ট প্রতিযোগিতা কমিশন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং ই-ভ্যালিকে আলাদা চিঠি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে। তাদের সময় দেওয়া হয়েছে ১৫ দিন।
২৫ আগস্ট থেকে ই-ভ্যালির পণ্য কার্ডে লেনদেন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ১ সেপ্টেম্বর ই-ভ্যালির ব্যবসায় পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে ই-ক্যাব সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক, ই-ক্যাবের একজন প্রতিনিধি, একজন আইনজ্ঞ ও একজন ই-কমার্স গবেষক রয়েছেন।
গত ২৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ই-ভ্যালি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।