মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। এর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে, কিন্তু বেড়েছে ঋণ দেওয়া। বেড়েছে খেলাপি ঋণও।
আবার ইসলামী ব্যাংক ছেড়ে যাচ্ছেন বিদেশি মালিকেরাও। প্রতিষ্ঠাকালীন (১৯৮৩) দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের ৭০ শতাংশ পুঁজি জোগান দিয়েছিলেন বিদেশিরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের শেয়ার কমে হয়েছে ৩২ শতাংশ।
২০১৩ সালে ইসলামী বাংক নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হওয়ার পরই ব্যাংকটি ছাড়তে শুরু করেন বিদেশিরা। গত ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তনের পর তা প্রকট হয়েছে। বিদেশিদের ছেড়ে দেওয়া শেয়ার বিভিন্ন নামে ২ শতাংশ করে কিনছে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত এক বছরে নতুন নতুন দেশীয় কোম্পানির নামে ব্যাংকটির ২৫ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়েছে।
পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তনের পর গত ২৪ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উদ্বেগ জানিয়ে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) প্রেসিডেন্ট বন্দর এম এইচ হাজ্জার লিখেছিলেন, আইডিবিসহ সৌদি আরব, কুয়েতের উদ্যোক্তাদের ৫২ শতাংশ শেয়ার থাকার পরও ব্যাংকটির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
তবে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশিরা শুরুর দিকে ব্যাংকে এসেছিলেন। তাই অনেকেই চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকে নতুন করে আসার আগ্রহও দেখাচ্ছেন। এটা নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।’
আরাস্তু খান আরও বলেন, ‘এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। তাই এই ব্যাংক নিয়ে সবার আগ্রহ বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংকে স্বাভাবিক কার্যক্রম ভালো চলছে, আমানতও বাড়ছে।’
ছেড়ে যাচ্ছেন বিদেশিরা
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক সূত্র জানায়, ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ১৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছিল ৭০ শতাংশ। বাকি অর্থের জোগান দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার এবং কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তবে ধীরে ধীরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার ছাড়তে শুরু করে।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে ইসলামী ব্যাংকের বেশ কিছু শাখা ও এটিএম বুথে ভাঙচুর হয়। ব্যাংকটির সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতির যোগসূত্র থাকার অভিযোগ ওঠে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া মীর কাসেম আলী ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক। ২০১৩ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত হলে তিনিও দেশ ছেড়ে চলে যান। ২০১৫ সালের জুনে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন মুস্তাফা আনোয়ার।
ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক তাদের হাতে থাকা পুরো শেয়ার বিক্রি করে চলে যায়। ২০১৫ সালে আরেক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দুবাই ইসলামিক ব্যাংকও সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
২০১৬ সালে দেশীয় ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হজরত শাহজালাল (রহ.) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি লিমিটেড ব্যাংকটির ৩ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৫টি শেয়ার কেনে। ওই বছরই ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) তাদের পক্ষে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় গ্রুপটির পক্ষে পরিচালক প্রত্যাহার করা হলে তাদের সব শেয়ার কিনে নেয় গ্র্যান্ড বিজনেস নামের চট্টগ্রামভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। মূলত এটাই ছিল ব্যাংকটির মালিকানা বদলের শুরু। ওই বছরই বিভিন্ন খাতের আরও আটজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁরা ব্যাংকটি পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরমাডা স্পিনিং মিলস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির শেয়ার কেনে এবং সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর গত ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। আরাস্তু খান নতুন চেয়ারম্যান হন।
বড় এই পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের ৮ কোটি ৬৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয় উদ্যোক্তা পরিচালক আইডিবি। গত মে মাসে প্রতিটি শেয়ার ৩১ টাকা ৫০ পয়সা দামে ২৭৪ কোটি টাকায় এসব শেয়ার কেনে বাংলাদেশেরই চার প্রতিষ্ঠান। আইডিবির ছেড়ে দেওয়া সিংহভাগ শেয়ার কিনেছে এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বদরুন নেসা আলম চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলমের বোন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকায় সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ইসলামী ব্যাংকের সোয়া ৫ শতাংশ শেয়ার ছিল। তবে এখনো কুয়েত সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান দ্য পাবলিক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল সিকিউরিটির নামে ১০ কোটি ৪০ লাখ ৪৪ হাজার ৯৪১ শেয়ার রয়েছে, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। ব্যাংকটিতে কুয়েতের তিন প্রতিষ্ঠানের ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক জেপি মরগানের একজন গ্রাহক ২০১৫ সালের শেষ দিকে ইসলামী ব্যাংকের ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ শেয়ার কেনে। সম্প্রতি শেয়ার ছেড়ে দেওয়ায় তাদের অংশীদার কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
ব্যাংকের অবনতি
পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের পর বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। একদিকে ব্যাংকটিতে আমানত আসা কমে গেছে, পাশাপাশি কমেছে আয়ও। অন্যদিকে বেড়ে গেছে ঋণ বিতরণ। খেলাপি ঋণও বেড়ে গেছে। তাই নগদ অর্থের সংকট তৈরি হয়েছে ব্যাংকটিতে। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা, গত জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা।
গত চার বছরের সঙ্গে তুলনা করলে ব্যাংকটিতে সবচেয়ে কম আমানত এসেছে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে। এই সময়ে আমানত এসেছে ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের প্রথম ছয় মাসে আমানত এসেছিল ৩ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। আর ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে আমানত আসে ৩ হাজার ৫৯৯ কোটি এবং ২০১৪ সালের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
আমানতপ্রবাহ কমলেও এই ছয় মাসে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ অবশ্য গত চার বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ৫ হাজার ৩১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। ২০১৫ ও ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৬৯৫ ও ২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো সর্বশেষ হিসাবে, ব্যাংকটির আমানতের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। ফলে ঋণ আমানত অনুপাত বেড়ে হয়েছে ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য এই সীমা সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ।