শেয়ারবাজার

ইপিএস কেন বাড়ে-কমে এবং কীভাবে

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য। ইপিএস বৃদ্ধি বা হ্রাসে ওই কোম্পানির শেয়ারের দামেরও হেরফের হয়। সাধারণভাবে ইপিএস বাড়লে তাতে শেয়ারের দাম বাড়ে। আর ইপিএস কমলে শেয়ারের দামও কমে যায়। এটি সাধারণ প্রবণতা। তবে সব সময় যে শেয়ারবাজারে শেয়ারের দামের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়, তা নয়।

কেন ইপিএসের কারণে শেয়ারবাজারে কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রভাবিত হয়? কারণ, কোম্পানির ব্যবসার মুনাফার চিত্রই ফুটে ওঠে ইপিএসে। কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে সব ধরনের খরচ বাদ দেওয়ার পর যে মুনাফা করে, সেই মুনাফাকে ওই কোম্পানির মোট শেয়ারসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ইপিএস বের করা হয়। দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো প্রতি তিন মাস পরপর তাদের ইপিএসের তথ্য প্রকাশ করে। বছরকে চার ভাগে ভাগ করে প্রতি তিন মাসে এক প্রান্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শেয়ারবাজারের কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রতি প্রান্তিক শেষে ইপিএস তথা লাভ-লোকসানের হিসাব প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক।

ধরা যাক, কোনো কোম্পানি তিন মাস ব্যবসা করে এক হাজার টাকা আয় করেছে। ওই কোম্পানির মোট শেয়ারসংখ্যা ১০০। সব ধরনের খরচ বাদ দেওয়ার পর কোম্পানিটির মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২০০ টাকা। তাহলে তিন মাস বা এক প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়াবে ২ টাকা। যদি দেখা যায়, কোম্পানিটির ইপিএস আগের প্রান্তিকের চেয়ে বা আগের বছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায়, তাহলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায় কোম্পানিটির ব্যবসা আগের চেয়ে বেড়েছে। এ কারণে মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর যদি দেখা যায়, আগের প্রান্তিক বা আগের বছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে ইপিএস কমে গেছে, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, কোম্পানিটি ব্যবসায় খারাপ করেছে। ব্যবসা ভালো-মন্দের বিচারে তাই শেয়ারের দামও বাড়তে বা কমতে পারে।

ইপিএস কখন বাড়ে, কেন বাড়ে

একটি পণ্য পরিবহনকারী জাহাজ কোম্পানির কথা ধরা যাক। ধরে নিই, কোম্পানিটির নাম এবিসি শিপিং। এ কোম্পানির আয়ের প্রধান উৎস জাহাজভাড়া। যদি ওই কোম্পানির জাহাজের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায় বা ভাড়া বেড়ে যায়, তাহলে ওই কোম্পানির আয় বেড়ে যেতে পারে। আবার ওই কোম্পানির বহরে যদি নতুন কোনো জাহাজ যুক্ত হয়, তাহলেও আয় বাড়বে। আবার জাহাজ ব্যবসার বাইরে কোম্পানিটি যদি অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা করে, তাতেও আয় বাড়তে পারে। এ বিনিয়োগের মধ্যে হতে পারে কোম্পানিটি ব্যাংকে বড় অঙ্কের কোনো স্থায়ী আমানত রেখেছে। অথবা শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা করে। আবার কোনো একটি প্রান্তিকে যদি জাহাজ কোম্পানিটি কোনো সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়, তাতেও হঠাৎ ওই কোম্পানির আয় অনেক বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া যদি হঠাৎ কোনো এক প্রান্তিকে কোম্পানিটি বড় ধরনের কোনো করছাড় পায়, তাতেও আয় বাড়তে পারে। জাহাজ কোম্পানিটি যদি আন্তর্জাতিক পরিসরে পণ্য পরিবহন করে এবং হঠাৎ যদি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যায়, তাতেও বাড়তি মুনাফা যুক্ত হতে পারে কোম্পানিটির। এ ছাড়া হঠাৎ কোনো প্রান্তিকে বড় অঙ্কের বকেয়া পাওনা আদায় হলে তাতে বাড়তে পারে আয়। উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়া কোম্পানিটির আয় বৃদ্ধির ছোটখাটো আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। আয় বাড়লেই যে সব সময় মুনাফা বাড়বে, তেমনি না–ও হতে পারে। ধরা যাক, ওপরের সব কটি কারণে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে কোম্পানিটির পরিচালন খরচ বা ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে, তাতে আয় বাড়লেও তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে মুনাফা না–ও বাড়তে পারে। তবে যদি কোম্পানির খরচ না বেড়ে হঠাৎ আয় বেড়ে যায়, তাতে কোম্পানিটির মুনাফা বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক।

সব মুনাফা কি টেকসই হয়

বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, কোম্পানির নিয়মিত বা মূল ব্যবসার বাইরে অন্য কোনো খাত থেকে যদি হঠাৎ আয় বেড়ে যায়, সেটি সব সময় স্থায়ী হয় না। এ কারণে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ইপিএস দেখে কোনো শেয়ারে বিনিয়োগের আগে কেন ইপিএস হঠাৎ বেড়ে গেল, তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন বিশ্লেষকেরা।

ইপিএস নিয়ে যত কারসাজি

আমাদের শেয়ারবাজারে অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রেই ইপিএস নিয়ে কারসাজির ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। শেয়ারের দাম বাড়াতে বা কমাতে কোম্পানির মালিকেরা এ কারসাজির আশ্রয় নেন। কেউ হঠাৎ খরচ কমিয়ে ইপিএস বাড়ান। আবার কেউ ইপিএস বাড়াতে মূল ব্যবসার বাইরে অন্য খাতে অর্থ লগ্নি করেন। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে বেশ কিছু কোম্পানি মূল ব্যবসা রেখে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের বিনিয়োগ করে সেখানকার মুনাফা দিয়ে ইপিএস বাড়িয়েছেন। কোম্পানির মালিকেরা অনেক সময় বেনামে তাঁদের কোম্পানির শেয়ার কিনে থাকেন। সেই শেয়ার বেশি দামে বিক্রি করতেই ইপিএস বাড়িয়ে দেখাতে নানা কারসাজির আশ্রয় নেন। একইভাবে কম দামে শেয়ার কিনতে ইপিএস কমিয়ে দেখান। এভাবেই ইপিএসকে শেয়ারের দাম বাড়ানো-কমানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন অনেক উদ্যোক্তা। তবে ভালো কোম্পানি ও ভালো উদ্যোক্তারা এ ধরনের কারসাজির আশ্রয় নেন না। এ কারণে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে ওই কোম্পানির উদ্যোক্তারা কেমন, তা জানাটাও বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।