ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে বাঁচানো সম্ভব না

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ফাইল ছবি
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।  ফাইল ছবি

উচ্চ আদালতের নির্দেশ এল প্রতিষ্ঠানটি বাঁচানোর। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার। তবে সেই দায়িত্ব নেওয়ার পর পুরো হতবাক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। অল্প দিনেই দেখলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) তহবিল খালি। আমানত বলতে কিছুই নেই। গ্রাহকদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। এক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারই নিয়ে গেছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকিং নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। অগত্যা পদত্যাগই একমাত্র পথ। অবশেষে সেই পথেই হাঁটলেন তিনি।

দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মাথায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। আদালতের নির্দেশে গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। আর গতকাল রোববার তিনি আদালত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এ সময় তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদেরও কোনো সহায়তা পাননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সক্রিয় না হলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে বাঁচানো সম্ভব হবে না বলেই মনে করেন তিনি।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একসময় ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালের দিকে নামে–বেনামে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনে মালিক বনে যান পি কে হালদার। এরপর নামে বেনামে ঋণ বের করেন। প্রথমে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। এমডি পদে থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পাশাপাশি আরও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অবসায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সবার চোখের সামনে পি কে হালদার চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সব সময়ই ছিল রহস্যজনক।

 জানতে চাইলে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে দেখলাম পি কে হালদারের গ্রুপ ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক ঋণ নয়। এখানে জালিয়াতি হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি বাঁচানো মুশকিল।’

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই একে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্ব নিতে হবে। আর জালিয়াতির বিচারের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে সক্রিয় হতে হবে। তাহলে যদি কিছু হয়।’

ইব্রাহিম খালেদ যেভাবে চেয়ারম্যান

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাত আমানতকারীর টাকা ফেরত চেয়ে করা আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৯ জানুয়ারি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের আদেশ দেন। পাশাপাশি নতুন চেয়ারম্যানকে সুসজ্জিত স্বতন্ত্র অফিস কক্ষসহ মাসিক সম্মানী হিসেবে তিন লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। তবে তিনি কোনো সম্মানী গ্রহণ করেননি।

সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের দুটি সভায় সভাপতিত্ব করেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। এ সভায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও খেলাপি ঋণ আদায়ে আদায়কারী এজেন্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

>

আদালত থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে
কিন্তু কাজ শুরু করে দেখলেন, এই প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর সাধ্য নেই
ফলে পদত্যাগ

আদালত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদনও জমা দেন তিনি। সূত্র জানায়, এতে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন দিকের উল্লেখ করেছেন। যেমন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহবুব জামিল। তখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী অবস্থায় ছিল। ২০১৬ সালে পি কে হালদার শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটি দখল করেন। এরপর ব্যবস্থাপনায় নিজেদের লোকজনকে বসান তিনি। চার পরিচালকের মাধ্যমে ৩৪টি হিসাবে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। এ ছাড়া শীর্ষ কর্মকর্তারা ঋণের নামে ১৫০ কোটি টাকা নিয়ে যান।

এ অবস্থায় করণীয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন করা ঠিক হবে না। এতে বাজারে খারাপ বার্তা যাবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখনই প্রশাসক বসিয়ে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিতে পারে। এরপর কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা হোক। সম্পদ ও দায় বিবেচনা করে স্কিমের অধীন টাকা ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘এসব উদ্যোগের পাশাপাশি অনিয়ম ও জালিয়াতিতে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। ঝুঁকিতে থাকা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে যাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা

২০১৫ সালে শেয়ার কিনে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় হাল ইন্টারন্যাশনাল, বিআর ইন্টারন্যাশনাল, নেচার এন্টারপ্রাইজ ও নিউ টেক এন্টারপ্রাইজ। এসব প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালেই কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। আবার হাল ইন্টারন্যাশনালের ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক পি কে হালদার নিজে ও তাঁর ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারের শেয়ার ১০ শতাংশ। এভাবে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নামে–বেনামে টাকা বের করেন পি কে হালদার।

পি কে হালদার যখন প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তখন একধরনের সম্মতি জানায়। আর সব শেষ হওয়ার পর ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রথমবারের মতো ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই প্রতিষ্ঠানটিকে ১ কোটি টাকার বেশি ঋণ অনুমোদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে বলা হয়। ২০১৮ সালে নগদ জমার (সিআরআর) ঘাটতির জন্য ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত বছরের ৫ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা উন্নয়নে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ে উচ্চ আদালতে এক প্রতিবেদন জমা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর ১৯ ফেব্রুয়ারি আদালত থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন নেচার এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি নওশেরুল ইসলাম ও মমতাজ বেগম এবং নিউ টেক এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি বাসুদেব ব্যানার্জি ও পাপিয়া ব্যানার্জি। পি কে হালদার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাঁরা পরিচালক হয়েছিলেন।

যাঁদের নামে ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নেওয়া ২ হাজার ২৯ কোটি টাকার মধ্যে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার সুবিধাভোগী পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীরা। পি কে হালদার এখন দেশছাড়া, অন্যরা বহাল তবিয়তে। দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন পি কে হালদার। এসব টাকায় বাংলাদেশের বাইরে ভারত ও কানাডাতেও কোম্পানি খুলেছেন, বাড়িও রয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুদকের আইনজীবী পি কে হালদারকে সহযোগিতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নরের কথা উল্লেখ করেছেন।

উল্লেখ্য, চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিতে কাগজে–কলমে যত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, তার বেশির ভাগের ঠিকানা পুরানা পল্টনের ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারের ১০ তলা ও কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারের অষ্টম ও ১৪ তলা। এসব প্রতিষ্ঠানের নামেই ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পি কে হালদার ও তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর পি কে হালদার এক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বের করেছেন। ফলে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেন তিনি।