সময়টা ছিল ২০১৪ সাল। ইতালির রোম থেকে ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে জাহাঙ্গীর আলম খান অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আসেন মো. আবদুল মান্নানের কাছে, জুতার ফ্যাক্টরি বানানোর প্রস্তাব নিয়ে। দুজনের পরিচয় হয়েছিল বছর বিশেক আগে মালয়েশিয়ায়। দুজনই তখন কাজ করতেন প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে। বহু বছর পরে, বহু ক্রোশ ঘুরে জাহাঙ্গীর আলম তখন রোমে ব্যবসা করেন। আর আবদুল মান্নান ভিয়েনায় স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী।
দেখা হওয়ার পরে দুজন বুদ্ধি আঁটেন দেশে ফিরে এসে জুতার কারখানা করার। এভাবেই দেশে তৈরি হয় ইটালি ফুটওয়্যার। মাত্র ছয় বছরে তাঁদের বার্ষিক আয় প্রায় ১৭ কোটি টাকা। তাঁদের ভাষায়, ‘এক পাটি জুতাও দেশে বিক্রি হয় না। পুরোটাই চলে যায় ইউরোপের বাজারে।’
ঢাকার উত্তরার হরিরামপুর ইউনিয়নের নলভোগে ছোট্ট কারখানা ইটালি ফুটওয়্যারের। সেখানেই কথা হয় ভাইয়ের মতো দুই বন্ধু জাহাঙ্গীর ও মান্নানের সঙ্গে। দুজনই দুজনকে ভাইয়া বলে ডাকেন। যতক্ষণ বাহ্যিক রূপ খুব খুঁটিয়ে না দেখা হবে, বোঝা দায় যে তাঁরা আসলেও আপন ভাই নয়। সেই যে জাহাঙ্গীর আলম গাড়ি চালিয়ে ভিয়েনা চলে এসেছিলেন, সে গল্পটাই আবদুল মান্নান বললেন অন্য এক দৃষ্টিকোণ দিয়ে। তিনি তখন ভিয়েনায় আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কূটনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে সবে মাস্টার্স শেষ করেছেন, পিএইচডি করবেন এমনই ইচ্ছা। ইতিমধ্যেই ভাগ্য অন্বেষণে তিনি ব্যয় করেছেন অনেক বছর। ফলে লেখাপড়া করে থিতু হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কম। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম নাছোড়বান্দা, তিনি কাঁথা–কম্বল নিয়ে ভিয়েনায় চলে এসেছেন মান্নানকে রাজি করাতে। অনেক হয়েছে, দেশে এবার তিনি ফিরে যাবেনই। দেশে জায়গা কিনে ছাউনি দেওয়ার কাজও শেষ। মান্নান ফিরলেই শুরু করতে পারবেন কাজ।
আমরা যারা শ্রমিক হিসেবে প্রবাসে যাই, আমাদের জীবনটা খুব কষ্টের। মরে গেলে এমনকি লাশটা দেশে আনার খরচও বহন করতে পারেন না অনেকে। আমি তাই সঞ্চয়ের টাকা দেশে জুতা তৈরির ব্যবসায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিইজাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম ইতালি গেছেন মালয়েশিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেন ঘুরে। স্বাভাবিক শ্রমিকের মতোই কষ্টকর শুরু ছিল তাঁর। প্রায় আট বছর পরিশ্রম করে কয়েকটা দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ইতালি চামড়ার পণ্যের জন্য বিখ্যাত। আকাশছোঁয়া দাম সেগুলোর। জাহাঙ্গীর ভাবতেন, চামড়াজাত পণ্যের এখানে এত দাম, আর এই সব চামড়া আমাদের দেশ থেকেই আসে সস্তা দরে। ‘আমরা যারা শ্রমিক হিসেবে প্রবাসে যাই, আমাদের জীবনটা খুব কষ্টের। মরে গেলে এমনকি লাশটা দেশে আনার খরচও বহন করতে পারেন না অনেকে। আমি তাই সঞ্চয়ের টাকা দেশে জুতা তৈরির ব্যবসায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিই,’—বলেন জাহাঙ্গীর আলম।
দীর্ঘদিন ইতালিতে কাজ করার কারণে জাহাঙ্গীর ইউরোপের বাজার খুব ভালো করে চিনতেন। তাই তিনি শুরুই করেন এমন একটা নাম নিয়ে, যা ইউরোপের বাজারে খুব অচেনা হবে না। প্রস্তুতি আরও পাকা করতে আবদুল মান্নান একে একে ঘুরলেন ইউরোপের ২৬টা শহর। বোঝার চেষ্টা করেন তাদের রুচি, চাহিদা, এমনকি দামের তারতম্যও।
আবদুল মান্নান আর চারজন ইতালীয় জুতা নির্মাতাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন জাহাঙ্গীর আলম। মেশিন পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয় ইতালির বাজার থেকে। কম দামের মেশিন, ব্যবহৃত। ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে শুরু হয় জুতার উৎপাদন। ডিসেম্বরেই ইউরোপের বাজারে চলে যায় ইতালি ফুটওয়্যারে তৈরি পণ্য। কিন্তু ইতালীয় জুতা নির্মাতা কেন? সহাস্যে জবাব দেন জাহাঙ্গীর আলম, ‘একদম কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। জুতা বানানো ইতালীয়দের রক্তে, একটা জুতায় একজন ইতালীয়র হাত পড়লে তাঁর মানই অন্য হয়। তাই যত ছোট করেই শুরু করি, এ বিষয়ে একদম কৃপণতা করিনি। এখনো একজন ইতালীয় কাজ করেন আমাদের সঙ্গে।’
ইতালির বাজার নিশ্চিত করে খুশি মনে শুরু করলেও সমস্যা আসে অন্য দিক থেকে। জাহাঙ্গীর আর মান্নানের ধারণা ছিল জুতা বানাতে লাগে শুধু চামড়া, মেশিন আর কারিগর। কিন্তু কাজে নেমে দেখেন, জুতা বানাতে আরও শ খানেক জিনিস লাগে। নানা ধরনের ফরমাশ নিয়ে হাজির হন ক্রেতারা। জুতার সুকতলায় ভেতরে একটা নরম ফোম লাগে। আবার জুতার নিচের তলা তৈরি করাই একটা আলাদা কারখানার কাজ। জুতা পুরো তৈরি করে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্র্যান্ডের নামসহ বাহারি বাক্স লাগে। সব মিলিয়ে এমন অনেক ছোট ছোট জিনিস লাগে যা ঢাকার বাজারে সহজলভ্য নয়। শুরু হয় নতুন যাত্রা, ছোট ছোট জিনিস সংগ্রহ, কিছু দেশে তৈরির ব্যবস্থা করা, কিছু বিদেশ থেকে আমদানি করা।
আবদুল মান্নান বলেন, জুতা কোনোভাবেই পুরো মেশিনে বানানো যায় না, এটা মেশিন ও হাতের সমন্বয়ের একটা কাজ। শুধু সুকতলা বানাতেই লাগে আটটা মেশিন, তারপর মানুষের কাজ তো আছেই। এ রকম প্রতিটি ধাপে কাজ করার পরে তৈরি হয় একটা নিখুঁত জুতা।
ইটালি ফুটওয়্যার জুতা বানিয়ে দেয় বাটা ইউরোপ, পিতারোসো, সারবিনো, কুইন হেলেনার মতো ব্র্যান্ডগুলোর জন্য। ইতালি ছাড়াও কানাডা, সুইডেন, জাপান, চীন ও জার্মানির অন্তত ১৫টি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাদের। আবদুল মান্নান বললেন, ‘আমাদের উদ্যোগ মাঝারি, যাদের জন্য কাজ করি তারাও মাঝারি। মিলেমিশে বড় হওয়ার একটা চেষ্টা করছি আমরা।’
ইটালি ফুটওয়্যারে এখন আছে ২০০ জন কর্মী আর মেশিন ১২০টি। দুই ভাই ছয় বছর ধরে হিসাব করে বের করেছেন, কতটুকু কাজ করতে ঠিক কতটুকু ব্যয় করতে হবে। জাহাঙ্গীর অকপটেই স্বীকার করেন, ‘শুরুতে না বুঝে অনেক অপচয় করে ফেলেছি, সেই ভুলই এখন খুব কাজে দিচ্ছে।’
ইটালি ফুটওয়্যার জুতা বানিয়ে দেয় বাটা ইউরোপ, পিতারোসো, সারবিনো, কুইন হেলেনার মতো ব্র্যান্ডগুলোর জন্য। ইতালি ছাড়াও কানাডা, সুইডেন, জাপান, চীন ও জার্মানির অন্তত ১৫টি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাদের।
করোনার বছর যখন সারা বিশ্বে কমে গেছে জীবনযাপনের পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি, ঠিক সেই বছরটিতেই ইতিমধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার জোড়া জুতা রপ্তানি করে ফেলেছে ইটালি ফুটওয়্যার। ছোট্ট কারখানাটি এখন কর্মব্যস্ত ইউরোপের বাজারে আগামী শীতের জুতার উৎপাদনের ফরমাশ নিয়ে। অনেক দেশে পাঠানো হয়েছে নতুন কাজের নমুনা, সেগুলো ছাড়পত্র পেলেই শুরু হয়ে যাবে উৎপাদন।
সম্প্রতি ইটালি ফুটওয়্যার বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিওএসএন) ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছে ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা। তাঁরা জানালেন, গাজীপুরের শ্রীপুরে জমিও কিনেছেন নতুন কারখানার জন্য। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে তৈরি ইটালি ফুটওয়্যার জয় করবে ইউরোপের বাজার, এটাই এখন মান্নান ও জাহাঙ্গীরের লক্ষ্য।