দেশে নতুন ধরনের ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠছে। পুরোনো ক্ষমতাকাঠামো ভেঙে পড়ছে। আগের ক্ষমতাকাঠামোটি ছিল কৃষিভিত্তিক। কিন্তু নতুন ক্ষমতাকাঠামোটি ইজারা ও ভাড়াভিত্তিক। এমনকি কৃষিশ্রমিকেরাও এখন আর আগের মতো অনিয়মিত শ্রমিক নন। তাঁরা এখন দল গঠন করে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। এই নতুন নিয়ন্ত্রণকাঠামোটি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠছে।
বাংলা একাডেমিতে চলমান ঢাকা লিট ফেস্টের গতকাল দ্বিতীয় দিনে ‘ডিকোডিং দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ শীর্ষক অধিবেশনে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন।
বিনায়ক সেন বলেন, উন্নয়নের মধ্যে আপাতস্ববিরোধ বা প্যারাডক্সের কথা বলা হয়, এক অর্থে তা সব দেশেই আছে। কারণ, ধনী দেশে গরিব মানুষ আছে—এই উক্তিকে আপাতস্ববিরোধী বা প্যারাডক্স বলা যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের যে পাহাড়সম সমস্যা ছিল, তা কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ যে উন্নতি করেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই উন্নয়নকে প্যারাডক্স বলা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভবত প্রাথমিক সমস্যাগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিনায়ক সেন বলেন, দেশ একসময় কৃষিনির্ভর ছিল। এখন কৃষিনির্ভরতা কমেছে, কিন্তু অসমতা বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, ধনীদের আয় যেখানে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে, সেখানে দরিদ্রদের আয় বাড়ছে ২–৩ শতাংশ হারে। এর সঙ্গে শিক্ষাগত পার্থক্যের কারণে অসমতা আরও বাড়ছে।
বিনায়ক সেন মনে করেন, নতুন এই ক্ষমতাকাঠামোর প্রকৃতিটা বোঝাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশে এখন অকৃষি খাতে কাজ বেড়েছে তা ঠিক, কিন্তু বেড়েছে মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। কেউ যদি প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ পেতে চান, তাহলে তাঁকে সেই খাতে কর্মরত একজন পরিচিত মানুষকে ধরে কাজ পেতে হয়। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ টিকাদান, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা সূচকে অগ্রগতি করেছে—এমন দাবির ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত।
এত উন্নয়ন সত্ত্বেও দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা আছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, উপনিবেশ আমল থেকেই বাংলাদেশে সামাজিক অগ্রগতির চালিকা শক্তি হলো শিক্ষা। কয়েক দশক ধরে শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়নও হয়েছে। কিন্তু এখনো মানসম্পন্ন শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য আছে। নতুন বাস্তবতা হলো, শিক্ষার সুযোগ তৈরি হলেও তা সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না।
হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, আরেকটি নতুন বাস্তবতা হলো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, আবার নিরাপত্তাহীতাও আছে। এ জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তাঁর মতে, জনগণের মধ্যে চাপ সৃষ্টির মতো উদ্যোগ নেই। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও সেটা নেই।
>ধনী দেশে গরিব মানুষ আছে—এই উক্তিকে আপাতস্ববিরোধী বা প্যারাডক্স বলা যেতে পারে। নতুন ক্ষমতাকাঠামোর প্রকৃতি বোঝাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
হোসেন জিল্লুর রহমান গ্রামীণ অর্থনীতি রূপান্তরের পেছনে একটি অন্যতম উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ষাট-সত্তরের দশকে গ্রামীণ অবকাঠামো তেমন ছিল না। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকে গ্রাম এলাকায় ব্যাপক রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়, যা জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষককে সম্পৃক্ত করে দেয়। এই উদ্যোগ গ্রামের অর্থনীতিকে বদলে দেয়। গ্রামের কৃষক তাঁর পণ্য নিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ঢুকে যেতে পারছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টার মতে, নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি গতি পায়। এত প্রবৃদ্ধির পরও এ দেশে সুশাসনের অভাব আছে।
এই অনুষ্ঠানে আরেক বিশেষ আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ। তাঁর মতে, সুযোগবঞ্চিত মানুষকে সুযোগ ও প্রযুক্তি দেওয়া হলে তাঁরা জীবন পরিবর্তন করতে পারেন। তাই এমন সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে মানুষ তা গ্রহণ করে।
কে এ এস মুরশিদ বলেন, ‘সত্তরের দশকে বর্গাচাষ, ক্ষমতায়নসহ কিছু কাঠামোগত সমস্যা ছিল। সেই সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। সত্তর ও আশির দশকে খাদ্যনিরাপত্তা সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল। এখন সেই অবস্থা নেই, এটাই!“মিরাকল”।’
সত্তরের দশকে এত আর্থসামাজিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন কে এ এস মুরশিদ। তাঁর মতে, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, তৈরি পোশাক রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ—এসবই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনে পরিবর্তন এনেছে। দারিদ্র্য কমেছে। দেশের গ্রামাঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এনজিওগুলোর ভূমিকাও আছে বলে তিনি মনে করেন।