>• রাজস্ব আয়
• এনবিআরের সঙ্গে সম্পর্কিত আয়কর, ভ্যাট এবং শুল্কের নানা দিক নিয়ে দুদকের চিঠি
• ফাঁকি ও মওকুফ কমলে রাজস্ব বাড়বে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা
• আয়কর অধ্যাদেশেই কালোটাকার মালিকদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে
কর ফাঁকি ও কর মওকুফ সুবিধা বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব আদায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে মনে করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দিয়ে এ কথা জানিয়েছে। বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ ও অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকদের যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা অবৈধ বা অপ্রদর্শিত অর্থ অর্জনের প্রবণতাকে উৎসাহিত করতে পারে বলেও মনে করে সংস্থাটি।
দুদক বলেছে, দেশের ১ শতাংশের কম মানুষ আয়কর দেন। আর, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় হয় মাত্র ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কর ফাঁকি ও মওকুফ বন্ধ হলে কর-জিডিপি অনুপাত ৫ শতাংশ বাড়বে, যা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
চিঠিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে সম্পর্কিত আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং শুল্ক—এই তিন অংশের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।
চিঠি দেওয়ার আগে দুদক দুটি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠনের মাধ্যমে এনবিআরের কার্যক্রম সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা, সরেজমিনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন, গণমাধ্যম থেকে নেওয়া তথ্য এবং গোয়েন্দা উৎস থেকে নেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করেছে দুদক। চিঠিতেও এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠি পেয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে চিঠি দিয়ে সুপারিশগুলো কার্যকর করার অনুরোধ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
আয়কর
আয়কর খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ১৩টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুদক। এর মধ্যে প্রথম উৎসই হচ্ছে খাতা–কলমে আয়কর নথি গ্রহণ। করদাতার তথ্য, রিটানের্র তথ্য ইত্যাদি এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে অনিয়ম-দুর্নীতির থাকে। নথি নিষ্পত্তির সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় না। আবার কর প্রণোদনা ও কর মওকুফের ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা স্বেচ্ছামাফিক ক্ষমতা ভোগ করেন।
দুদকের পর্যবেক্ষণে এসেছে, আয়কর বিভাগের কিছু কর্মকর্তা আইন, বিধি ও নিয়মবহির্ভূত আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অঘোষিত পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। এদিকে সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ (সিএ) ও আয়কর আইনজীবীর মতো পেশাজীবীদের এনবিআরে নিবন্ধন করার সুযোগ নেই। সিএ ফার্ম ও করদাতা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে নিরীক্ষা প্রতিবেদনও জালিয়াতি হয়।
এদিকে বদলি, পদায়নে প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে এনবিআরের শিথিলতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। আবার প্রতিবছর মেলার সময় বিলাসবহুল প্রচারণার মাধ্যমে অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে।
আমদানি শুল্ক
শুল্ক বিষয়ে দুর্নীতির ১৫টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুদক। বলেছে, পণ্যের গুণগত মান, পরিমাণ, মূল্য কমিয়ে দেখানো ও বাড়িয়ে দেখানো ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা কাস্টম হাউসগুলোর প্রচলিত অনিয়ম। আমদানি করা ও খালাস করা পণ্যের চালান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায়ই সমন্বয় করা হয় না। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে খালাস না হলেও নিলাম হয় না।
বিশ্বব্যাপী শুল্ক তথ্যের জন্য স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি (আসাইকুডা) চালু থাকলেও কাস্টমস বিভাগ তা সার্বিকভাবে চালু করতে পারেনি। এ বিভাগের কার্যক্রম এখনো অস্বচ্ছ ও সনাতন পদ্ধতিতে হচ্ছে। দুর্নীতি হচ্ছে মানসম্মত বন্ড ব্যবস্থাপনা না থাকায়ও।
প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যেরও অভাব রয়েছে। যেমন পর্যাপ্ত স্ক্যানার মেশিন, সিসি ক্যামেরা ও ওজন নির্ধারক নেই। যেসব মেশিন আছে, সেগুলোও অকেজো থাকে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অকেজো করে রাখা হয়। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের রয়েছে অবৈধ যোগসাজশ।
এ ছাড়া বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত নিরীক্ষা হয় না। আমদানি-রপ্তানিতে আসাইকুডার অংশ ছাড়া বন্ড ওয়্যারহাউস কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা সনাতন পদ্ধতিতে করা হয়।
মূসক
মূসক নিয়েও দুর্নীতির চারটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে দুদক। বিভিন্ন রেয়াত, মূল্য ও ট্যারিফের নিম্ন ভিত্তি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অনেক সময় রেয়াত নেওয়ার বিপরীতে সঠিক দলিল বা প্রমাণপত্র থাকে না। বিদ্যমান মূসক পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো এখনো সনাতন পদ্ধতির।
বর্তমান মূসক ব্যবস্থায় ১৫ শতাংশ হারে মূসক এবং এ হারের চেয়ে কম ট্যারিফ মূল্যে মূসক পরিশোধের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু কাঁচামালের ওপর মূসক পরিশোধ করা হয়েছে কি না, কর্তৃপক্ষ তা যাচাই করে না।
এ ছাড়া শুল্ক ও মূসক অনুবিভাগের শুল্ক ও মূসক আদায়, নিয়োগ, বদলি এবং পদোন্নতিসংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই। এগুলো না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।
সুপারিশ
করদাতাবান্ধব, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে এনবিআরের কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনার বিকল্প নেই বলে মনে করে দুদক। এ জন্য আয়কর নিয়ে করণীয় হচ্ছে সামর্থ্যবান নাগরিকদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা, ই-কর ব্যবস্থা চালু, স্বয়ংক্রিয় উৎসে কর ব্যবস্থাপনা চালু, এনবিআরের ওয়েবসাইটকে ব্যবহারকারীবান্ধব করা, অস্তিত্বহীন ব্যবসায়িক আয়ের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু করা।
শুল্ক এবং মূসকের ক্ষেত্রে সুপারিশগুলো হচ্ছে শুল্ক বিভাগের কর্মচারীদের ক্ষমতা কমানো, সৎ ও দক্ষ কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া, শুল্ক গোয়েন্দা কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা, উদ্দীপনা পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা, আমদানি-রপ্তানিতে ঘোষিত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের অনলাইন
পদ্ধতিতে রাখা, মূল্যায়নপ্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ বন্ধ করা, মূসক আদায়ে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার বসানো ইত্যাদি।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে সংস্থাটির সদস্য (করনীতি) কালীপদ হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদকের প্রতিবেদনে যেসব পর্যবেক্ষণ এসেছে, সেগুলোকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি এবং কর্মকতাদের সতর্ক ও উজ্জীবিত হওয়ার স্বার্থে এ ধরনের প্রতিবেদনের দরকার আছে বলেও মনে করছি।’ আরেক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ইতিমধ্যে কমিশনারদের চিঠি দিয়ে দুদকের পর্যবেক্ষণের কথা জানানো হয়েছে। তবে এ পর্যবেক্ষণ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবার আগে জরুরি।