কোভিড মহামারি চলছেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর মধ্যেও শতাধিক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশকে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের অর্ধেক আবার বেসরকারি দাতাদের দিতে হবে। বাস্তবতা হলো, অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে গেছে এবং অনেক দেশের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো নয়, তাতে অনেক দেশই খেলাপি হয়ে যাবে। অনেকেই হয়তো সীমিত সম্পদ দিয়ে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করবে এবং তা করতে গিয়ে অতিপ্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে ব্যয় কমাবে। এর মধ্যেও অনেক দেশকে ঋণ নিতে হবে। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন মুদ্রানীতিতে নানা পরিবর্তন এনে তারল্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে সেই ঋণ পাওয়াও খুব কঠিন কিছু হবে না।
ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে কী হয়, তার নজির কিন্তু অনেক: ১৯৮০-এর দশকটি তো বলা হয় লাতিন আমেরিকার হারিয়ে যাওয়া দশক বা সম্প্রতি গ্রিসের কথাও বলা যায়। এখন ঋণসংকট তৈরি হলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন। পৃথিবীজুড়ে অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। অনেক তরুণই ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কাজ খুঁজতে যাবেন। আর এখন যদি আবার এই অভিবাসন সংকট তৈরি হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আড়ালে চলে যাবে। এই ধরনের মানবিক জরুরি অবস্থা ক্রমেই নতুন রীতি হয়ে উঠছে।
তবে আমরা এখনই কাজে নেমে পড়লে এই দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি এড়ানো যাবে। আজকের এই ঋণসংকটের উৎস বোঝাটা কঠিন কিছু নয়। নোট ছাপানোর কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সরকারি ঋণ (সিংহভাগই সার্বভৌম বন্ড) ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর তিন গুণ হয়েছে। ব্যাপারটা হলো, সার্বভৌম বন্ড বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া ‘আনুষ্ঠানিক’ ঋণের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ ঋণদাতারা মর্জিমাফিক তা প্রত্যাহার করতে পারেন। এতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও অন্যান্য সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।
২০১৩ সালেই আমাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল যে ক্ষুদ্র দৃষ্টির আর্থিক বাজার সমমনা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশ্বের পরবর্তী ঋণসংকটের ভিত্তি তৈরি করছে। এখন সেই অপকর্ম বিচারের সময় এসেছে। গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এ বছর ঋণ পরিশোধ থেকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জি–২০ ভুক্ত দেশ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাতে বেশ সাড়াও দিয়েছে। পাশাপাশি, বেসরকারি ঋণদাতাদেরও তারা একই পদাঙ্ক অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই সেই আহ্বান খুব বেশি মানুষের কানে ঢুকতে পারেনি। নব গঠিত আফ্রিকা প্রাইভেট ক্রেডিটর ওয়ার্কিং গ্রুপ গরিব দেশগুলোকে ঋণ ছাড় দেওয়ার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতারা যে ছাড় দেবে, তার সুফল ভোগ করবে বেসরকারি ঋণদাতারা, যারা কোনো ধরনের ছাড় দিতে অনাগ্রহী।
পরিণতিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অতি মাত্রায় ঝুঁকি গ্রহণ ও বাছবিচারহীন ঋণ দেওয়ার জন্য আবারও বেইল আউট করতে হবে। বলা বাহুল্য, সেটা করতে হবে আবার জনগণের করের টাকায়। এটা এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে ঋণ পরিশোধ পুরোপুরি বন্ধ করা, যার মধ্যে বেসরকারি ঋণদাতাদেরও যুক্ত করতে হবে। ঋণগ্রহীতা দেশগুলোকে সে জন্য কঠোর অবস্থানে যেতে হবে, তা না হলে বেসরকারি ঋণদাতারা এই প্রস্তাব মানবে না। আর সে জন্য ঋণগ্রহীতাদের চুক্তি আইনের বেশ কিছু ধারা যেমন, প্রয়োজনীয়তার নীতির ব্যবহার করতে হবে।
তবে ঋণ পরিশোধ বন্ধ করলেই কেবল এই অতিরিক্ত ঋণের রীতিবদ্ধ সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। এর জন্য আমাদের জরুরি ভিত্তিতে ঋণ পুনর্গঠন দরকার। ইতিহাস বলে, পুনর্গঠন স্বল্প মাত্রায় বা দেরিতে করা হলে আরেকটি সংকটের বীজ বপন হয়।
তবে সমাধানও আমাদের হাতের নাগালেই আছে, যদিও সেটা খুব একটা ব্যবহার হয় না। সেটা হচ্ছে, স্বেচ্ছায় সার্বভৌম ঋণ বাই ব্যাক করা। করপোরেট জগতে ঋণের বাই ব্যাক খুবই সাধারণ ঘটনা। ১৯৯০-এর দশকে লাতিন আমেরিকা ও সম্প্রতি গ্রিসের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ডেবট সোয়াপের ক্ষেত্রে যে কঠোর শর্তাবলি দেওয়া হয়, এ ক্ষেত্রে সেটা থাকে না, তাই এটা জরুরি।
তবে দীর্ঘ মেয়াদে আন্দাজ করা যায় ও নিয়মতান্ত্রিক ঋণ পুনর্গঠন ব্যবস্থা জরুরি, অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের মিউনিসিপ্যাল ব্যাঙ্করাপটসি লেজিসলেশনের আলোকে। আর সেটা হবে ২০০৮ সালের পর জাতিসংঘের এক্সপার্টস অন রিফর্মস অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল মনেটরি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের সুপারিশের আলোকে।
জোসেফ স্টিগলিৎজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
হামিদ রশিদ: জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের গ্লোবাল ইকোনমিক মনিটরিং বিভাগের প্রধান।