আর্থিক লেনদেনে অনলাইন-নির্ভরতা বেড়েছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গ্রাহকেরা ব্যাংক শাখায় যাওয়া কমিয়েছেন। ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেন করছেন আগের চেয়ে বেশি গ্রাহক। আবার দূরত্ব বজায় রাখতে সব ধরনের কার্ডের লেনদেন আগের চেয়ে বেড়েছে।

শুধু ব্যাংক গ্রাহকেরা নন, মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএস লেনদেনও বাড়ছে। গ্রাহকেরাও এখন লেনদেন সারছেন অ্যাপসের মাধ্যমে। এর ফলে অতিমারির এই সময়ে ঘরে বসে আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারছেন গ্রাহকেরা। এর সবকিছু সম্ভব হয়েছে হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট সুবিধা আসার কারণে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত জুলাই মাসে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কার্ডের মাধ্যমে বেশি লেনদেন হয়েছে। সেটা ডেবিট ও ক্রেডিট—দুটো কার্ডের ক্ষেত্রে। ওই সময়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। অবশ্য এটা সম্ভব হয়েছে দেশে ফোর-জি নেটওয়ার্কের কাভারেজের জন্যই।

করোনার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশে অ্যাপসের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আগে ২০ শতাংশ গ্রাহক অ্যাপস ব্যবহার করতেন। এখন ৪০ শতাংশ গ্রাহক অ্যাপসনির্ভর।

ইন্টারনেট প্রাপ্তি ও সহজলভ্য হওয়ায় গ্রাহকেরা অ্যাপসে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন বিকাশের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা একবার অ্যাপস ব্যবহার করছেন, তাঁরা বারবার অ্যাপসেই সেবা নিচ্ছেন। কারণ, এর সুবিধা অনেক বিস্তৃত। আমরাও নিয়মিত অ্যাপসে নতুন সুবিধা যুক্ত করছি। এখন অ্যাপসের মাধ্যমে পরিষেবা বিল পরিশোধ, ক্রেডিট কার্ড বিল, ব্যাংক লেনদেন ও মোবাইল রিচার্জ বেশি হচ্ছে।’

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকের লেনদেনে যে স্থবিরতা এসেছিল, তাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। এমনকি গ্রাহকেরা এখন শাখার পরিবর্তে অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) ও পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) থেকে টাকা উত্তোলন ও লেনদেনে বেশি আগ্রহী। কারণ, এর ফলে ব্যাংক শাখায় না গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আর্থিক চাহিদা মেটানো যাচ্ছে।

এদিকে করোনার কারণে ব্যাংকগুলো এটিএম, পিওএস ও ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন (সিডিএম) স্থাপন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। জুলাইয়ে এসে ব্যাংকগুলো আবার সেবা চ্যানেল বিস্তৃত করা শুরু করেছে।

বাংলাদেশে কার্ড সেবায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, আগের চেয়ে কার্ড ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার বাড়ছে। কারণ, করোনার কারণে এখনো অনেকে শাখায় গিয়ে সেবা নিতে চাইছেন না। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিকল্প সেবা মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে।

জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে এটিএম বুথ ছিল ১১ হাজার ২টি। এপ্রিলে নতুন করে কোনো বুথ বসেনি, বরং মে মাসে আরও একটি বুথ কমে যায়। জুন মাসে এটিএম বুথ বেড়ে হয় ১১ হাজার ৪৭, আর জুলাইয়ে তা আরও বেড়ে হয় ১১ হাজার ১০৬টি।
তবে ব্যাংকের পয়েন্ট অব সেলসে মিশ্র প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে পিওএস ছিল ৬৪ হাজার ৩৩৯। এপ্রিলে পিওএস বেড়ে হয় ৬৫ হাজার ৪৯৯, মে মাসে ৬৫ হাজার ৬১৯ ও জুন মাসে ৬৫ হাজার ৯৪৬। তবে জুলাইয়ে পিওএস কমে হয় ৬৫ হাজার ৬৮৩।

ব্যাংকাররা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে ব্যবসা বা শাখা বন্ধ করে ফেলছে। এ কারণে পিওএস কমে গেছে। আবার সিটি ব্যাংক পিওএসের পরিবর্তে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন চালু করেছে, যে কারণে পিওএসের হিসাবে মিশ্র প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এদিকে গত বছরের অক্টোবর থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নতুন করে তেমন ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন (সিডিএম) স্থাপন করেনি। তবে জুলাই মাসে এসে নতুন করে ১৪টি সিডিএম বসিয়েছে। ফলে জুলাই শেষে দেশের সিডিএমের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪২৩। শাখায় ভিড় এড়াতে অনেক ব্যাংক এখন সিডিএম স্থাপনে জোর দিয়েছে।

গত মার্চ মাসে ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ড ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ। এপ্রিল ও মে মাসেও কার্ড ১ কোটি ৯৪ লাখের মধ্যে সীমিত ছিল। জুন মাসে এসে কার্ড বেড়ে হয় ১ কোটি ৯৭ লাখ। আর গত জুলাইয়ে ডেবিট কার্ড বেড়ে হয় ১ কোটি ৯৯ লাখ।

ডেবিট কার্ডে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। তবে করোনার কারণে গত এপ্রিলে লেনদেন কমে হয় ৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। মে মাসে লেনদেন হয় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ও জুন মাসে ১২ হাজার কোটি টাকা। আর গত জুলাইয়ে লেনদেন হয় ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।

ক্রেডিট কার্ড নতুন করে সেভাবে বাড়েনি। চলতি বছরে ক্রেডিট কার্ডে ১ হাজার ১০০ কোটি থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। তবে গত এপ্রিলে তা কমে হয় ৫২৩ কোটি টাকা, মে মাসে ৭১৩ কোটি টাকা ও জুন মাসে ৮৯৮ কোটি টাকা। তবে গত জুলাইয়ে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয় ১ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। একইভাবে প্রিপেইড কার্ডেও গত জুলাইয়ে লেনদেন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

সব মিলিয়ে গত জুলাইয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় ১৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা, যা গত এপ্রিলে কমে হয়েছিল ৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। সাধারণ সময়ে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো।

ব্যাংকাররা জানান, আগে অনেক গ্রাহক কার্ড নিতে চাইতেন না। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইন লেনদেনের জন্য এখন আগের গ্রাহকেরা কার্ড খুঁজছেন। ফলে কার্ডের ওপর চাপ বেড়েছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কার্ডে লেনদেন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এ ছাড়া গ্রাহকেরা এখন অনলাইন সেবায় বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। এ জন্য ব্যাংকগুলো এদিকে নজর দিচ্ছে।

এদিকে ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা গ্রাহকও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গত এপ্রিলে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক ছিল ২৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৪ জন, জুলাইয়ে যা বেড়ে হয়েছে ২৮ লাখ ৪১ হাজার ৭১৪ জন। আর লেনদেনও ৪ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা দিতে ব্যাংকগুলোর আলাদা অ্যাপস রয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। গত জুলাইয়ে মোট লেনদেন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৯৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগের মাস জুনে মোট লেনদেন ছিল ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে মোবাইলে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। চলতি বছরের জুলাই শেষে এ খাতে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭৩ হাজার, যা জুনে ছিল ৮ কোটি ৮৭ লাখ ৯৭ হাজার। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সেই সঙ্গে ফোর-জি ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা গ্রাহকদের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নিতে উৎসাহিত করছে।