দেশে দেশে ঘুষ-দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি, লুটপাট-প্রতারণা ও অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কালোটাকার মালিক হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আবার অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নেওয়া এসব অর্থ অন্য দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অবৈধ ও বেআইনি পন্থায় অর্থ উপার্জন এবং তা অন্য দেশে পাচার করার প্রবণতা ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরেই সারা পৃথিবী সোচ্চার। তবু অখ্যাত-অজ্ঞাত, ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নতনির্বিশেষে অধিকাংশ দেশেই অন্য দেশের অবৈধ অর্থ আকর্ষণে সুবিধা দেওয়া হয়।
অবৈধ উপায়ে অন্য দেশ থেকে অবৈধ অর্থ পাচার উৎসাহিত করতে কর ছাড়সহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি অর্থ স্থানান্তরকারীর সব তথ্য গোপন রাখা হয়। কোন দেশ কতটা গোপনীয়তা রক্ষা করে, তা নিয়ে ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন) নামের এক সংস্থা গত সপ্তাহে একটি সূচক প্রকাশ করেছে।
সূচকটির নাম দেওয়া হয়েছে ফিন্যান্সিয়াল সিক্রেসি ইনডেক্স বা আর্থিক গোপনীয়তা সূচক (এফএসআই)। এই সূচকের শীর্ষ স্থানে রয়েছে কেম্যান আইল্যান্ড। এর পরের চারটি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুর। শীর্ষ দশে থাকা বাকি পাঁচ দেশ হলো যথাক্রমে লুক্সেমবার্গ, জাপান, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
১৩৩টি দেশকে নিয়ে তৈরি করা তালিকায় বাংলাদেশ ৫৪তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সামনে শ্রীলঙ্কা ৩৯তম, ভারত ৪৭তম স্থানে আছে। এ ছাড়া মালদ্বীপ ৭৪তম ও পাকিস্তান ১০০তম স্থানে রয়েছে। সর্বশেষ স্থানটি কুক আইল্যান্ডসের।
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন) জানায়, সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা পাওয়ার কারণে সারা বিশ্বে বেসরকারি খাতের লোকজন এক দেশ থেকে অন্য দেশে এ পর্যন্ত ২১ থেকে ৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বা সম্পদ স্থানান্তর করেছে। বিপুল এই অর্থের বিপরীতে স্থানান্তরকারীরা কোনো রকম কর দেননি বা দিলেও তা নামমাত্র। সাধারণত ব্যাপক হারে কর ছাড় পাওয়ায় ও সিক্রেসি জুরিসিডকশনের আওতায়, অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে এমন শর্তেই মূলত বিশ্বজুড়ে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ অবৈধ উপায়ে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক দেশই সম্পূর্ণ কর ছাড় সুবিধা কিংবা নামমাত্র কর নিয়েই অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের এ সুযোগ দিয়ে থাকে। এসব দেশকে ট্যাক্স হ্যাভেন বা করস্বর্গ বলা হয়। এ জন্য বেশ কিছু দেশের নাম সুবিদিত।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধ অর্থ মানে কালোটাকা স্থানান্তরের পরিমাণ নেহাত কম নয়, তা ১ কোটি ট্রিলিয়ন থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ট্রিলিয়নের মতো হবে বলে অনুমান করা হয়। এ অর্থ সারা বিশ্বের এক বছরের বৈদেশিক সাহায্যের চেয়ে প্রায় ১২ গুণ বেশি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ব্যাপকভাবে অবৈধ অর্থ স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ওই মহাদেশ থেকে মোট এক লাখ কোটি ডলারের সম্পদ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গেছে। অথচ একই সময়ে আফ্রিকার সব কটি দেশ মিলে বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে ২০ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ আফ্রিকার দেশগুলো যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে, তার পাঁচ গুণ বেশি অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। একদিকে এসব দেশ বৈদেশিক ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছে, অন্যদিকে তাদের তথাকথিত ধনী বা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীরা বিদেশে সম্পদ পাচার করছে।
টিজেএনের মতে, গত শতকের আটের দশকে ফিন্যান্সিয়াল গ্লোবালাইেজশন বা অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার পর থেকেই মূলত কর ফাঁকি দেওয়া এবং অবৈধ অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংক, আইনি ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষায়িত সেবা প্রদানকারী সংস্থার একটি চক্র গড়ে উঠেছে। আইনের ফাঁকফোকর গলে কীভাবে কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচার করা যায় ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা যায়, তারা সেই সহযোগিতা দেয়। অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিক পরিমাণে অর্থ পাচারে আকৃষ্ট করতে বৈশ্বিক আর্থিক খাতে অবৈধ সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেন অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলে।