বিদেশি ব্যবসায়ীদের তুলনায় দেশি ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি বেশি হয়েছে।
শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো দুই বছরের জন্য স্থগিত চান দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এই সময়ে শিল্পকারখানায় ব্যাপক হারে বিনিয়োগের পাশাপাশি উৎপাদনও কমেছে। তবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর তুলনায় দেশীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে বেশি।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দেশে যখন করোনা সংক্রমণজনিত মৃত্যু ও আক্রান্তের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন অনেক কারখানাই তাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। তবে করোনার মধ্যে কারখানা একবারের জন্যও বন্ধ করেনি এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এই হার অবশ্য বিদেশি কোম্পানির মধ্যে বেশি। সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ৩০ শতাংশ জানিয়েছে, দেশে টানা দুই মাসের সাধারণ ছুটি চলাকালেও তারা কারখানার কার্যক্রম চালু রাখতে সক্ষম হয়েছে। টানা ছুটির সময়ে দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কারখানাগুলোর ৫৯ শতাংশই জানিয়েছে, তারা সাধারণ ছুটির সময় কারখানার কার্যক্রম ধরে রেখেছে। কিন্তু বেশির ভাগ দেশীয় কোম্পানি বলেছে, সাধারণ ছুটির সময় তারা কারখানার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। এই হার ৮৩ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমেছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর চেয়ে দেশীয়দের ক্ষতি হয়েছে বেশি।
বিডায় নিবন্ধন করে যেসব দেশি-বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, তাদের ওপর চলতি বছরের ২৪ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করা হয়। দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে ২ হাজার ১৪৪টি কোম্পানির কাছে ই-মেইলে ২৬টি প্রশ্নসংবলিত জরিপ ফরম পাঠানো হয়েছিল। এতে সাড়া দিয়েছে অবশ্য ৭৪৮টি কোম্পানি। এগুলোর মধ্যে ৫২৪টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ে দেশের ব্যবসায়ীরা কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন, তা দেখার জন্য আমরা যৌথভাবে জরিপটি করেছি। সরবরাহব্যবস্থা, শ্রমিক ও কর্মসংস্থান, অর্থায়ন এবং ব্যবসার প্রবৃদ্ধি—এই চারটি থিমের ওপর ২৬টি প্রশ্ন করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। আমরা শুধু সমস্যা বের করার ওপর জোর দিয়েছি। তবে বিদেশি কোম্পানির তুলনায় দেশি কোম্পানিগুলো কেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।’
জরিপে অংশ নেওয়া ৮৮ শতাংশ দেশীয় কোম্পানি জানিয়েছে, করোনার কারণে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮০ শতাংশ জানায়, তাদের পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ৭০ শতাংশ উদ্যোক্তা বলেছেন, তাঁদের বিনিয়োগ ও শ্রমিকের উৎপাদনসক্ষমতা কমেছে। অবশ্য ১০ শতাংশ কোম্পানি বলেছে, কোভিডের মধ্যেও কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা জানান, করোনার সময়ে তাঁরা কর্মীদের বেতন দিতে সক্ষম হয়েছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের ৮ শতাংশ জানান, করোনার কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়লেও তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চলমান মহামারির মধ্যেও এগিয়ে যেতে চান।
জরিপে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ বিদেশি কোম্পানি জানিয়েছে যে করোনাকালে তাদের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে কোনো ধরনের প্রভাব পড়েনি। ৩০ শতাংশ বিদেশি ব্যবসায়ী বলেছেন, কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই তাঁরা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে সক্ষম। তবে এখানেও ৭৮ শতাংশ বলেছেন, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমেছে। ৭৩ শতাংশ বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ পেতে আগ্রহী। ৭ শতাংশ কোম্পানি ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়াতে চায় বলে জানিয়েছে।
বিডা ও আইএফসির জরিপমতে, করোনার সময়ে দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানার কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়ে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম ক্ষতি হয়েছে। ৪২ শতাংশ কোম্পানি এমন কথা বলেছে। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি চলে যাওয়ার প্রবণতাও কম।
বিডা ও আইএফসির জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের দিক থেকে মোট ১৩ দফা সুপারিশ উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, করোনা মোকাবিলার স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, বিশেষ করে পিপিই, ভেন্টিলেটর, সার্জিক্যাল মাস্ক ইত্যাদি উৎপাদনে বিশেষ ছাড় দেওয়া। বিদেশি কোম্পানিগুলো অর্থ প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া সহজ করতে বলেছে। অন্যদিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, করোনা তাদের ব্যবসাকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে ফেলেছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পরবর্তী দুই বছর কর্মীদের বেতন না বাড়ানোর কথা জানায় তারা। অর্থাৎ কর্মীদের বেতন বাড়ানোর যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার কথা বলেছেন ব্যবসায়ীরা।