তহশিলদার থেকে সচিব—সবাই কঠিন হয়ে গেছেন। কেউ একটা ফাইল সহজে ছাড়তে চান না। সরকারি কর্মকর্তাদের একটি নীতিমালা তৈরিতে সময় লাগে দুই বছর। প্রজ্ঞাপন জারি করতে লাগে আরও দুই বছর। অনেক সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কর্মকর্তারা হঠাৎ কোনো পণ্যে ভ্যাট বসিয়ে দেন। আবার তাঁদের কাজেরও কোনো জবাবদিহি নেই। উন্নয়ন প্রকল্প বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখলেও তাঁদের কোনো শাস্তি হয় না।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রাক্–বাজেট আলোচনায় এভাবেই আমলাদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা আমলাদের উদ্দেশে বলেন, ‘ব্যবসাটা সহজে করতে দিন। হয়রানি কমান। ভোগান্তি কমান।’
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে। এতে ডিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে মোট ২২টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ব্যবসায়ীদের বক্তব্য শুনে বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পৃথিবীর সব সমাজেই চলে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে এখানে এটি বেশি হয়। গত ১০ বছর সরকারের সঙ্গে থেকে অলিগলিতে ঘুরেছি। এখানে এক জায়গায় হাত দিতে গেলে ২০ জায়গা নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে ভয়ে চেপে যাই। এসব এভাবেই চলবে।’
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অথরিটির (কর্তৃপক্ষের) একটা ভাব থাকে। কোনো একটি দপ্তর করতে গেলেই সেখানে অথরিটি লাগিয়ে দেয়। এই যেমন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) করা হলো। এই নাম নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আমার মতে, বিডা না হয়ে এর নাম হওয়া উচিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ প্রচার সংস্থা বা বিপা, যেখানে কর্তৃপক্ষের কোনো ভাব থাকবে না। সেবা দেওয়ার মানসিকতা থাকবে।’
এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রীর উদ্দেশে মেঘনা গ্রুপের এমডি মোস্তফা কামাল বলেন, ‘স্যার, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অদম্য। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো আমাদের নেতিবাচকভাবে দেখে। স্যার, আপনারা আমাদের শুধু ব্যবসাটা সহজ করে করতে দেন। দেখেন আমরা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাই।’
মেঘনা গ্রুপের এমডি বলেন, ‘এখানে তহশিলদার থেকে সর্বোচ্চ সচিব পর্যন্ত সবাই কেমন যেন কঠিন হয়ে গেছেন। আমার একটা ফাইল ছাড়াতে সাত বছর লেগেছে। ফাইলের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয়, নথিটি সরকারের নিয়ম অনুযায়ী চলমান রহিয়াছে।’
মোস্তফা কামাল আরও বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ীদেরও যে ভুলত্রুটি নেই তা বলব না। তবু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর প্রতি অনুরোধ, আপনারা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কাজ করবেন।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম মঙ্গলবার। সেখানে শিক্ষার্থীরা আমার কাছে জানতে চায়, আমাদের ভবিষ্যৎ কী? আমরা কি চাকরি পাব? তারা আমার কাছে চাকরি চায়। তারা আমাকে জানায়, তাদের রাজনীতির কানেকশন নেই। তাই সরকারি চাকরি হবে না। কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়?’
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির মতো দেশেও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হচ্ছে তাদের মূল ভিত্তি। আমাদের দেশেও এটা করতে হবে। সেটি করতে হলে ব্যবসাটা সহজ করতে হবে। ব্যবসার পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে।’
সাংসদ এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক গড়ে করপোরেট করহার এখন ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে তা ৩০ শতাংশ। দেশে করপোরেট করহার কমছে না। সরকার গুটি কয়েক চোরকে লক্ষ করে পুরো বিষয়টিকে সাধারণ করে ফেলেছে। তিনি বলেন, সরকার হঠাৎ করে জমিতে ভ্যাট বসিয়ে দিল। অথচ কারও সঙ্গে আলোচনা করা হলো না। এনবিআরকে মানসিকতা পরিবর্তন করতে বলেন তিনি।
হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের ধীরগতির কথা উল্লেখ করেন সফিউল ইসলাম। বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের অদক্ষতার কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। অথচ এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনেক কাজ নিজেরা করে ফেলে। সেসব নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করা হয় না। অথচ পাঁচ বছর আগেও এমনটা ছিল না। এ সময় সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ব্যবসায় ভোগান্তি ও হয়রানি কমান।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, দেশে সরকারের নীতিকৌশলের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। কোনো নীতি খণ্ডকালীন চলতে পারে না। এটি পাঁচ বছরের জন্য করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘আগামী বাজেটে লিস্টেড ও নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমাতে হবে। করপোরেট ডিভিডেন্ডের আয়ের ওপর বিদ্যমান ২০ শতাংশ করের পরিবর্তে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে।’ এ ছাড়া বার্ষিক টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা চার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সমকাল–এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।