চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরু থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। একেকটি মাস যায় আর এনবিআর রাজস্ব আয়ের মূল লক্ষ্য থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। তাতে বাড়ছে ঘাটতি। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী সংস্থার এই অবস্থা দেখে অর্থমন্ত্রীর কপালে ভাঁজ পড়ার কথা। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কপালে সেই ভাঁজ তো পড়েনি; উল্টো তিনি কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) আশানুরূপ খরচ হচ্ছে না। অর্থবছরের ১০ মাসে এডিপির মাত্র ৫৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রতিবারই বাজেটের আয়-ব্যয়ের এই চিত্র দেখা গেলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আদায়ে বড় লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব নয়। আর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতির ওপর চাপ বাড়াবে।
আয়-ব্যয়ের চিত্র
চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটের প্রায় ৬৫ শতাংশের জোগান দিতে হবে এনবিআরকে। বছরের শুরুতে এনবিআরকে ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে গত ৯ মাসে আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশের কিছুটা বেশি।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। তাতে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। আদায় কম হওয়ায় এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য সংশোধন করে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। তাতে অর্থবছরের শেষ তিন মাসে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
এনবিআরের তথ্যে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব ঘাটতি ১৫ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এ খাতে আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। আর স্থানীয় পর্যায়ে মূসক আদায় হয়েছে ৬০ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এ খাতে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি রয়েছে ১৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। আয়কর ও ভ্রমণ কর আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা।
এদিকে রাজস্ব বাবদ সরকারের আয়ের বড় অংশই খরচ হয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদাসলও পরিশোধ করতে হয়। চলতি অর্থবছরে বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তাতে এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে অবশ্য তা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সংশোধিত এডিপির প্রায় ৫৫ শতাংশ খরচ হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৯৭ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এবার সংশোধিত এডিপির আকার ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর ধরেই প্রথম ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনোবারই সংশোধিত এডিপির পুরো টাকা খরচ করা সম্ভব হয় না। তাই বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯০-৯২ শতাংশের মধ্যেই থাকে।
বাজেটের আয়-ব্যয়ের চিত্রটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী আয় করতে পারে না, আবার উন্নয়ন খাতে ব্যয়ও করতে পারে না। উভয় দিকেই সক্ষমতার অভাব আছে, আছে লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনায় গলদ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর এনবিআরকে অতি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য দেওয়া হয়। যখন এই লক্ষ্য সংশোধন করা হয়, তাও বাস্তবভিত্তিক হয় না। ফলে সংশোধিত লক্ষ্যও অর্জিত হয় না। আবার প্রতিবছর সংশোধিত লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে পরের বছরের এনবিআরের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ব্যাপক কর ছাড়ের বিষয়টি লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হয় না। অন্যদিকে এডিপিতে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সঠিক পরিকল্পনার অভাব আছে। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাবও আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতির ওপর চাপ বাড়াবে।