অল্প হলেও অর্থনীতি কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে

মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার আসবাবের কারখানাগুলো দুই মাস বন্ধই ছিল। এখন আবার সেখান থেকে কাঠচেরাইয়ের শব্দ পাওয়া যায়, সেটা গভীর রাতেও।

এমনই একটি কারখানার মালিক মো. রাজা জানান, তাঁর কারখানায় এক মাস ধরে উৎপাদন চলছে। সরবরাহ আদেশও কিছু পাওয়া যাচ্ছে। এক মাসে তিনি সাড়ে চার লাখ টাকার আসবাব সরবরাহ করেছেন, স্বাভাবিক সময়ে সেটা হয়তো আরও দুই লাখ টাকা বেশি হতো।

মো. রাজা বলেন, বাজারে আসবাবের চাহিদা কম। তাই লাভের অংশ কমিয়ে দিয়ে সরবরাহ আদেশ ধরতে হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি ও কারখানার ভাড়া ওঠার মতো দাম পেলেই তিনি আসবাব তৈরির সরবরাহ আদেশ নিচ্ছেন।

কারখানামালিক রাজা আরও বলেন, খুচরা দোকানে কিছু কিছু আসবাব বিক্রি হচ্ছে। আবার যেসব ব্যবসায়ীর কাছে টাকা আছে, তাঁরা কম খরচে এখন আসবাব তৈরি করিয়ে রাখছেন। এ কারণেই তিনি সরবরাহের কাজ পাচ্ছেন।

কাজীপাড়ার এসব কারখানা বেগম রোকেয়া সরণির দোকানগুলোতে আসবাব সরবরাহ করে। সেখানকার তিনটি দোকানে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, পণ্য বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক। তবে এপ্রিলে বন্ধ, মে মাসে বন্ধ দশার পর জুনে কিছুটা বিক্রির মুখ দেখেছে দোকানগুলো।

আইডিয়াল ফার্নিচার নামের একটি দোকানের ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কিছু বিক্রি হয়। কিছু টাকা পাই। তা থেকে শ্রমিক-কর্মচারীরা কিছু টাকা পান। কোনোরকমে সংসার চলে। বন্ধ থাকলে তো কিছুই পেতাম না।’

আসবাব হলো সেই সব পণ্যের একটি, যা সংকটকালে খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কেনে না। বাসায় খাট না থাকলেও মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমানো যায়। অপরিহার্য নয় ডাইনিং টেবিল, ড্রেসিং টেবিল বা সোফা সেটও। করোনাকালে যদি আসবাব কিছু কিছু বিক্রি হয়, তাহলে অন্য খাতের কী অবস্থা?

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে মার্চে সাধারণ ছুটি শুরুর পর ব্যবসা-বাণিজ্য যে গভীর খাদে পড়েছিল, সেখান থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটেছে। জুন মাসে এসে পণ্য বিক্রি বেড়েছে। কোনো কোনো খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও হয়েছে।

মুঠোফোনে বেশি প্রবৃদ্ধি

সুসময় যাচ্ছে মুঠোফোন বিক্রেতাদের। বিদেশ থেকে অবৈধভাবে মুঠোফোন আসছে না। বিদেশফেরত মানুষেরা হাতে করে যেসব ফোন নিয়ে আসেন, তা-ও বন্ধ। ফলে দেশীয় বৈধ মুঠোফোন বিক্রেতারা বিক্রিতে বেশ ভালো গতি দেখছেন।

স্যামসাং ব্র্যান্ডের ফোন উৎপাদনকারী ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের বিপণন প্রধান মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দীন বলেন, সার্বিকভাবে জুন মাসে প্রায় ৮ লাখ ইউনিট মুঠোফোন বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি।

ওয়াশিং মেশিন বিক্রিও বেড়েছে

ফেয়ার ইলেকট্রনিকস রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম উৎপাদন ও বিক্রি করে। মেসবাহ উদ্দীন বলেন, তাঁদের বাজার পর্যালোচনা অনুযায়ী করোনাকালে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর টেলিভিশন বিক্রি ১২ শতাংশ বেড়েছে। ওয়াশিং মেশিন বিক্রি বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। রেফ্রিজারেটর বিক্রি বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। এ হিসাব সেই অর্থে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো বাজার জরিপ নয়।

>

জুনে বিক্রি ভালো হয়েছে। কারখানা উৎপাদনে ফিরেছে। তবে এই ভালো সময় কতটা টেকসই হয়, তা নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা।
করোনাকালের অর্থনীতি অল্প হলেও অর্থনীতি কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে 

অবশ্য এটা মনে রাখা দরকার যে রেফ্রিজারেটর ও অন্যান্য সরঞ্জামে বড় হিস্যাধারী দেশীয় ব্র্যান্ড। করোনাকালে সংকটে বেশি পড়েছেন চাকরিজীবী, মধ্যম ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষেরা। তাঁরাই মূলত দেশীয় ব্র্যান্ডের বড় ক্রেতা।

রেফ্রিজারেটরের বাজারে সবচেয়ে বড় হিস্যাধারী ওয়ালটন। ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) গোলাম মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, এপ্রিল-মে মাসে বিক্রি কমেছিল। তবে সে তুলনায় জুন-জুলাইয়ে এখন পর্যন্ত বিক্রি দ্বিগুণের কাছাকাছি।

মোটরসাইকেলের চাকাও ঘুরছে

মোটরসাইকেলের বাজারে এপ্রিলে বিক্রি কমেছিল ৯৬ শতাংশ। আর জুনে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। কারণ দুটি; এক. মানুষ সামাজিক দূরত্ব মেনে যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেল কিনছেন। দুই. যাঁরা আগে কেনার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, তাঁরা কিনছেন।

টিভিএস অটো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ‘এই ভালো অবস্থা কতটা স্থায়ী হবে, তা বলা কঠিন। তবে একেবারে খারাপ অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি।’

দেশের নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও খাদ্যপণ্যের বাজারে (ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস বা এফএমসিজি) করোনার প্রভাব ততটা মারাত্মক ছিল না। তবে এপ্রিল মাসটি খারাপই গেছে। মে মাসে পরিস্থিতির আবার উন্নতি হয়েছে বলে দেখা যায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাজার জরিপে। জরিপ অনুযায়ী এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে এফএমসিজির বাজারে বিক্রি বেড়েছে ২১ শতাংশ। অবশ্য জুনের হিসাব আসেনি।

নানা ধরনের পণ্যের ব্যবসায় নিয়োজিত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে পণ্যের বিক্রি বাড়ছে। আমরা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছি।’

স্কয়ার টয়লেট্রিজের বিপণন প্রধান জেসমিন জামানও জুনে পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হওয়ার খবর দিলেন।

দুশ্চিন্তা কেটেছে সিমেন্টেও

করুণ দশা কাটিয়ে উঠেছে নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনকারী কারখানাও। সিমেন্ট খাতের তথ্য অনুযায়ী জুন মাসে গত বছরের একই মাসের তুলনায় সিমেন্ট বিক্রি ৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। এর কারণ, আগের দুই মাসে যেসব নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল, তা শুরু হয়েছে। ফলে একসঙ্গে বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে। অবশ্য বছর শেষে সিমেন্ট খাতে ১৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা আছে, যা সাধারণত ১০ শতাংশের বেশি ইতিবাচক থাকে। রডের বাজারের বিক্রি আগের তুলনায় বাড়তি। তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, জুনে সিমেন্ট বিক্রি ভালো হয়েছে। এর বড় কারণ মানুষ সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজে নেমে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম অর্থনীতি অনেকটা খারাপ অবস্থায় পড়ে যাবে। শিল্পকারখানা বন্ধ ছাড়া উপায় থাকবে না। এখন মনে হচ্ছে, সে আশঙ্কা নেই।’

বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলীহোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, বিক্রি বেড়েছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের মতো নয়। এখনো অবস্থা খারাপ।

সমস্যা হলো, এই প্রবৃদ্ধি অনেকটা এসেছে দুই মাস ব্যবসা মোটামুটি বন্ধ থাকার পর। মানে হলো, এপ্রিল ও মে মাসে যাঁরা কেনাকাটা করতে পারেননি, তাঁরাই জুনে কিনেছেন। ফলে এই বাড়তি বিক্রি বাজার ঘুরে দাঁড়ানো কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করোনা-পূর্ব সময়ের অবস্থায় যেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তাই বছর শেষে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ এখনই পাল্টাচ্ছে না করপোরেটরা।

দেশে করোনায় আক্রান্ত প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। সাধারণ ছুটি শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। এক মাস জরুরি পণ্য ও সেবা ছাড়া মোটামুটি সবকিছু বন্ধ ছিল। রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। ২৬ এপ্রিল পোশাক কারখানা খোলা শুরু হয়। ঢাকামুখী মানুষ বাড়তে থাকে। ৫ মে থেকে আরও কিছু কারখানা খোলে, বেসরকারি অফিস সীমিতভাবে খোলা শুরু হয়।

১০ মে থেকে ঈদের কেনাকাটার জন্য খোলে দোকানপাট ও বিপণিবিতান। ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ও ঈদের পর ৩০ মে থেকে ঢাকায় সবকিছু খুলে দেওয়া হয়।

এরপর থেকে পণ্য রপ্তানি ও আমদানিতে কিছু গতি এসেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, এপ্রিলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮৩ শতাংশ। জুনে পরিস্থিতির উন্নতি হয়, নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় আড়াই শতাংশে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহনের বাড়তির ধারা দেখলেও তা অনেকটা বোঝা যায়।

পুনরুদ্ধারের ধরন নিয়ে বিতর্ক

বিশ্বব্যাপী এখন অর্থনীতিবিদ ও করপোরেটের সিইওরা (প্রধান নির্বাহী) অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের রূপ নিয়ে আলোচনা করছেন। কেউ বলছেন পুনরুদ্ধার ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতির হবে, কেউ বলছেন ‘ডব্লিউ’ আকৃতির হবে। কারও মত সেটা হবে ‘এল’ আকৃতির অথবা ‘ইউ’ আকৃতির।

ভি আকৃতির পুনরুদ্ধার হলো, দ্রুত পতন হয়ে দ্রুত উত্থান। ডব্লিউ হলো, দ্রুত পতন হয়ে দ্রুত উত্থানের পর সেখান থেকে আবার পতন, পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানো। এল আকৃতি মানে হলো, পতন হওয়ার পর সে অবস্থায় চলতে থাকা। ইউ আকৃতি মানে হলো, পতন হওয়ার পর একটা বড় সময় সে অবস্থায় থাকার পর খাড়াভাবে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া।

পুনরুদ্ধারের আরেকটি আকৃতি হলো মার্কিন স্পোর্টস ফ্যাশন ব্র্যান্ড নাইকির লোগোর মতো, যাকে বলা হচ্ছে ‘নাইকি শ্যুশ’। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, নাইকি হলো বিজয়ের দেবী, যার পাখাও রয়েছে। দেবী নাইকির পাখার আকৃতিতে ফ্যাশন ব্র্যান্ড নাইকির লোগো তৈরি হয়েছে। এ আকৃতির পুনরুদ্ধারে দ্রুত পতন হয়ে ধীরে ধীরে উন্নতি হয়।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাত আপাতত ভি আকৃতির পুনরুদ্ধার দেখছে। বেশির ভাগের আশঙ্কা, ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার একটা পতন আসবে, তবে সেটা এপ্রিল-মের মতো ততটা মারাত্মক হবে না। তারপর আবার ঘুরে দাঁড়াবে বিভিন্ন খাত। সব মিলিয়ে তাদের ধারণা, খাতভিত্তিক পুনরুদ্ধার ডব্লিউ আকৃতির হবে। অবশ্য সবকিছু নির্ভর করছে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তার ওপর।

করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক বিমান চলাচল, পরিবহন, পর্যটন, রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতান, বিলাস পণ্য ইত্যাদিতে পুনরুদ্ধার কোন আকৃতির হবে, তা কেউ ধারণা করতে পারছে না।

দেশের রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, জুনে ততটা খারাপ না করার কারণ হলো, পুরোনো ক্রয়াদেশের বিপরীতে পণ্য নিয়েছেন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। পরবর্তী মৌসুমের পণ্যের কিছু কিছু রপ্তানি আদেশ আসছে।

চামড়া খাতের সংগঠন লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, আগামী মৌসুমের জন্য কিছু কিছু ক্রয়াদেশ মিলছে। তবে উৎপাদনক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরেকটি দিক হলো, চীনের পাশাপাশি অন্য উৎস থেকে বিদেশি ক্রেতাদের পণ্য কেনার যে প্রবণতা তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তার সুফল কিছুটা বাংলাদেশ পেতে পারে। তা অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি নয়।