টাকা দিয়ে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এর বাইরে আরও কমপক্ষে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন আর্থিক খাতের আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। ওই টাকা দিয়ে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। তবে আত্মসাতের কথা স্বীকার করলেও তাঁর দাবি, তিনি টাকা পাচার বা বিলাসিতা করেননি।
তবে বাস্তবতা হলো, বিদেশেও তাঁর সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। পি কে হালদারের সম্পদ থাকার কথা জানিয়ে কমপক্ষে তিনটি দেশ চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশকে। নামে-বেনামে তাঁর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমপক্ষে ২৫। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য মিলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনেও বেরিয়ে আসে, পি কে হালদার কমপক্ষে ২৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে টাকা বের করেছেন। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা ঋণের সুবিধাভোগী তিনি।
পি কে হালদার সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে চিঠি দিয়ে দেশে ফিরে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। এর সঙ্গে নিজের জীবনবৃত্তান্ত ও তাঁর মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
পি কে হালদার যেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বলে স্বীকার করেছেন সেগুলো হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে, মার্চেন্ট ব্যাংক হাল ক্যাপিটাল, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও আলিফ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, ব্রোকারেজ হাউস কেএইচবি সিকিউরিটিজ। এর বাইরে শেয়ারবাজারের কোম্পানি নর্দান জুট, রহমান কেমিক্যালও তাঁর বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া কক্সবাজারের নির্মাণাধীন র্যাডিসন ব্লু হোটেলে তাঁর ৭০ শতাংশ শেয়ার থাকার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি আজিজ ফাইবার, আনন কেমিক্যাল, হাল ট্রাভেল (হাল ট্রিপ), হাল টেকনোলজি ও রেপটাইল ফার্ম তাঁর মালিকানাধীন।
দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া পি কে হালদার দেশে এলে কোনো হয়রানি না করার ও নিরাপদে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার শর্ত দিয়েছেন। এ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে তিনি আবেদন করলে প্রতিষ্ঠানটি আদালতে যায়। আদালত এতে সম্মতি দিয়ে পি কে হালদার কবে আসতে চান, তা জানতে চেয়েছেন।
৯ সেপ্টেম্বর রাতে পি কে হালদার হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে ফিরে হয়রানি করা হবে না—এ সুযোগ দিলে আমি ফিরতে চাই। তবে কবে ফিরব, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’ এত টাকা ও এত প্রতিষ্ঠান কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নিলেন—এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে কথা বলব না। আমার ওপর কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। দেশে ফিরলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) সঙ্গে বসব। তখন বিস্তারিত জানাব।’
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকতে কীভাবে পি কে হালদারের মতো একজন এমন অপকর্ম করতে পারলেন। আবার তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদে কারা ছিলেন, কারা ব্যবস্থাপনা করেছেন, এটাও দেখতে হবে। নিশ্চয়ই তাঁর পেছনে বড় কোনো ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক নেতা আছেন, না হলে এত সুযোগ তিনি পেতেন না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এসব লোককে নতুন করে সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এ থেকে কেউ না কেউ শিক্ষা পাবে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে পাঠানো চিঠিতে পি কে হালদার লিখেছেন, ‘রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকার সময়েই উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’ এরপরই একে একে শেয়ারবাজার ও বাইরের প্রতিষ্ঠান দখল করে নেওয়ার তথ্য দেন তিনি। তাঁর প্রথম ব্যবসায়িক অধিগ্রহণ রেপটাইল ফার্ম বলে জানিয়েছেন, যা বাংলাদেশের একমাত্র বাণিজ্যিক কুমির চাষের খামার। এরপরই তিনি অধিগ্রহণ করেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং ও রহমান কেমিক্যাল লিমিটেড। রহমান কেমিক্যাল তরল চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি পার্বত্য এলাকায় কাসাভা উৎপাদন করছে।
পি কে হালদার চিঠিতে বলেছেন, ‘আজিজ ফাইবার লিমিটেড আমার আরও একটি অধিগ্রহণ করা প্রতিষ্ঠান, যা আগে বন্ধ ছিল। অধিগ্রহণের পর এটি চালু করা হয়েছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘আনন কেমিক্যাল আমাদের আরও একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যা পানি পরিশোধনে ব্যবহৃত কেমিক্যাল উৎপাদন করে। হাল ট্রাভেল সার্ভিসেস (হাল ট্রিপ) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন ট্রাভেল প্রতিষ্ঠান, যা প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। হাল টেকনোলজি লিমিটেড এ রকম আরও একটি প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন ব্যাংককে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিচ্ছে।
পি কে হালদার বলেছেন, ‘কক্সবাজারের হোটেল র্যাডিসন ব্লু আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই হোটেলে আমাদের শেয়ার ৭০ শতাংশ। এতে ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।’
এর বাইরে আর্থিক খাতে কিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের তথ্য তুলে ধরেন পি কে হালদার। তিনি লিখেছেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এতে আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ার রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে আমাদের মনোনীত চারজন পরিচালক রয়েছেন। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো শেয়ার রয়েছে। পুরো পর্ষদেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। এর বাইরে হাল ক্যাপিটালের শতভাগ শেয়ার আমাদের। আলিফ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট আরও একটি প্রতিষ্ঠান, যার পুরো শেয়ার আমাদের হাতে। শেয়ারবাজারের লেনদেনের ব্রোকারেজ হাউস কেএইচবি সিকিউরিটিজের পুরো নিয়ন্ত্রণও আমাদের হাতে।’
পি কে হালদারের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার ব্যবসায়িক স্বার্থ বা সংযুক্তি আছে। আমার অনুপস্থিতির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা খুব ব্যাহত হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি আমি বাংলাদেশে ফিরতে পারি এবং আমার ব্যবসা স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারি, তাহলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সময়মতো টাকা ফেরত পাবে।’
চিঠিতে পি কে হালদার লিখেছেন, ‘বাজরে গুজব রয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং থেকে আমরা ২ হাজার কোটি টাকা নিয়েছি। কিন্তু সত্য হলো, প্রতিষ্ঠানটিতে আমাদের কোনো দায় নেই। আরও একটি গুজব আছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে আমরা ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছি। কিন্তু এখানেও আমাদের কোনো দায় নেই। ঋণ নেওয়া সব টাকা আমরা দেশে বিনিয়োগ করেছি, দেশের বাইরে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।’
সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পি কে হালদার ৮-৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি ২৫-২৬টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছেন। আশা করছি, তিনি দেশে এসে টাকা ফেরত দেবেন।’
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ঘোষণার বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে তাঁর মালিকানা থাকার তথ্য মিলেছে। যেমন পি কে হালদার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইন্টারনেট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান (আইজিডব্লিউ) ফার্স্ট কমিউনিকেশনের পরিচালক। সুখাদা লিমিটেডে পি কে হালদারের শেয়ার ৯০ শতাংশ ও তাঁর মা লীলাবতী হালদারের ৫ শতাংশ। আবার সুকুজা ভেঞ্চারের শেয়ার সুখাদা লিমিটেডের কাছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) নিয়ন্ত্রণ সুকুজা ভেঞ্চারের হাতে।
পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল আনন কেমিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। আনন কেমিক্যালের মালিক পি কে হালদার নিজেই বলে চিঠিতে জানিয়েছেন। ফলে সব মিলিয়ে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পি কে হালদারের মালিকানা থাকার তথ্য পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে বিভিন্ন নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) দখল করেন পি কে হালদার। সেই চার প্রতিষ্ঠানের একটি বিলুপ্তির পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন তিনি, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খুলেছেন।
এর বাইরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুবিধাভোগী পি কে হালদার বলে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেগুলো হলো বর্ণা, ইমেক্সোকো, আরবি এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ, সন্দীপ করপোরেশন, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, ড্রাই নুন অ্যাপারেলস ও সুখাদা প্রপার্টিজ।
এর আগে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন আদালত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই পদত্যাগ করেন। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, পি কে হালদার মূল ব্যক্তি, যিনি পুরো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছেন। তাই তাঁকে ফিরিয়ে এনে টাকা আদায় করলে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। পাশাপাশি এভাবে লুটপাটের বিচারও হতে হবে। কারণ, এ দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।