দেশে শ্রমিক হত্যার ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিসহ ৯ দফা সুপারিশ দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে গণতদন্ত কমিটি। মজুরি আন্দোলনে শ্রমিক হতাহতের ঘটনা অনুসন্ধানে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে আহ্বায়ক করে ২৬ সদস্যের এই কমিটি গত ২২ মার্চ গঠন করা হয়।
আজ শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে গণতদন্ত কমিটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় প্রধান দায় রাষ্ট্রের প্রশাসন, পুলিশ ও মালিকপক্ষের। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চারজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। পুলিশ ও তৎকালীন সরকারি দলের ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ শ্রমিকদের ওপর হামলা করেছে, গুলি করে হতাহত করেছে। উল্টো শ্রমিকদের নামেই মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে আটক করেছে। হয়রানি এখনো অব্যাহত রেখেছে। শ্রমিক হত্যার যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। গত জুলাই–আগস্ট মাসে শ্রমিক–শিক্ষার্থী–জনতার ওপর গুলি চালিয়ে যে বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে তা ওই সব ঘটনারই ধারাবাহিকতা। এ আন্দোলনে শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, নূ৵নতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করা শ্রমিকদের ওপর গুলি করেছে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সন্ত্রাসী বাহিনী। এবার ছাত্র–জনতার ওপর হামলায় একই চিত্র দেখা গেছে। শ্রমিকদের আন্দোলন দমনে ‘গুন্ডা বাহিনীর’ সঙ্গে কাজ করেছে যে পুলিশ, তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, গণতদন্ত কমিটি ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁরা কমিটি গঠনের বৈধতা আছে কিনা জানতে চান। নাগরিকদের যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে সেটা ওই কর্মকর্তারা ভাবেননি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আগের সরকারের মতো এ সরকারও সব আন্দোলনকে চক্রান্ত বলছে। শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক মানুষের স্বার্থ দেখার দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে, একই ধারার সরকার পরিচালনা হলে কোনো পার্থক্য হবে না। ছাত্র–জনতার আন্দোলনে হতাহত শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ শ্রমজীবী পরিবারের। তাঁরা আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে গণতদন্ত কমিটির সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, পোশাকশিল্পের মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় ও শ্রমিকদের দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত শিল্পাঞ্চল পুলিশ বিলুপ্ত করতে হবে। শ্রমবান্ধব নতুন আইনের প্রয়োজন।
শ্রমিক হত্যার তদন্ত ও বিচারে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘তদন্তের জন্য পৃথক কমিশন গঠন করতে হবে। কারণ পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশকে যথাযথ তদন্ত করতে দেখা যায় না। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের বারবার সতর্ক করবে এবং প্রয়োজনে হাঁটুর নিচে গুলি করবে, এমন প্রবিধান আছে। এই আইন ছাত্র–জনতার আন্দোলনের জন৵ প্রযোজ্য ছিল। অথচ কোনো ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এমনটা শোনা যায়নি।’
প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন গণতদন্ত কমিটির সদস্যসচিব বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি জহিরুল ইসলাম। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর পুলিশের ছররা গুলিতে রাসেল হাওলাদার ও আগুনে পুড়ে ইমরান হোসেন মারা যান। রাসেল ডিজাইন এক্সপ্রেস কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান এবং ইমরান হোসেন এবিএম ফ্যাশন লিমিটেডের কর্মী ছিলেন। একই বছরের ৮ নভেম্বর পুলিশের ছররা গুলিতে মারা যান ইসলাম গ্রুপের কর্মী আঞ্জুয়ারা বেগম। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন দিন পর মারা যান একই কারখানার জালাল উদ্দিন। শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় কোনো তদন্ত না করে ২২ হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৮ জন শ্রমিক সংগঠককে।
গণতদন্ত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, আইন ভঙ্গ করলে পুলিশের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও দায় নিতে হবে। আমলানির্ভর নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। মজুরি নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট মেয়াদে তার পুনর্বিন্যাসের জন্য গ্রহণযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া থাকতে হবে। মজুরি বকেয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণা বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার বাধাগ্রস্ত করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করতে হবে। হতাহত ব্যক্তিদের জীবনের জন্য যথেষ্ট হয় এমন ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন গণতদন্ত কমিটির দুই সদস্য গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাদিয়া আরমান এবং নিহত শ্রমিক রাসেল হাওলাদারের বাবা আবদুল হান্নান হাওলাদার।
গণতদন্ত কমিটির সদস্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ম. হারুন–অর–রশিদ, শ্রমজীবী আন্দোলনের আহ্বায়ক হারুনার রশিদ ভুঁইয়া, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার এবং চা–শ্রমিকদের ১০ দফা বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা আবদুল্লাহ আল কাফি।