দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে নির্বাচন, মানবাধিকার এবং সুশাসনের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। নিজেদের এমন প্রত্যাশার কথা সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বলেছে দেশটি। এমনকি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে গত ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েছেন, সেখানেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের যে বৈঠক হতে যাচ্ছে, সেখানেও নির্বাচন এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে বলে ঢাকা এবং ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।
আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হতে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় দুপুরে এই বৈঠক হবে। এর আগে গত বছরের ৪ এপ্রিল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে ওয়াশিংটনে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছিল।
ঢাকা এবং ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলের ঢাকা সফরের সময়ও গণতন্ত্র, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ যাতে অঙ্গীকার পূরণ করে, সে কথা বলে গেছেন। ফলে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আলোচনায় এ প্রসঙ্গগুলো আবারও অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবেন—এমন আভাস মিলেছে। গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশ আগামী দিনগুলোতে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, সে সম্পর্কে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে গেছেন আব্দুল মোমেন। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আলোচনায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতি এবং অবস্থান তিনি তুলে ধরবেন।
ওয়াশিংটনে এবারের আলোচনায় আগামী নির্বাচনের বিষয়টি যে গুরুত্ব পাবে, সেটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন নিজেও স্বীকার করেছেন। গত বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা চায় বাংলাদেশে যেন স্বচ্ছ, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগের নীতিও নির্বাচন। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছি। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়েছেন গণতন্ত্র সমুন্নত করার জন্যই। সে কারণে আমাদের গণতন্ত্র শেখানোর প্রয়োজন নেই। এটা আমাদের অস্থিমজ্জায়। আমাদের রক্তে গণতন্ত্র। সরকার যে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী, আমরা সেটা তাদের জানাব।’
সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কারও অন্য ধরনের কোনো চিন্তা থাকলে তা ভুল চিন্তা।
নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক বেশি সম্পৃক্ততা চায় বাংলাদেশ। ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর উন্নয়ন অগ্রযাত্রা মসৃণ রাখতে হলে বাংলাদেশে অব্যাহত বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বাজার-সুবিধা নিয়েও আলোচনা করতে চায় বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয়ের মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক যুক্ততার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা জানানো হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে নির্বাচন, মানবাধিকার এবং সুশাসনের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধ করার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারে এবং মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে বলে মনে করছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা এবং প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়গুলোও আসতে পারে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, জিএসপি পুনর্বহাল, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা ও প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার মতো বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া আগামী মে মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফর নিয়েও আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী ওই সফরে যাবেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং এই বাহিনীর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর দুই দেশের সম্পর্কের একধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টা রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখার আর গত ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে ঢাকা সফরের পর দুই দেশের সম্পর্কে যে অস্বস্তি ছিল, তা কমে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক তিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সফরের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এই বার্তা দেওয়া হয় যে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়াশিংটন।
এমনকি গত জানুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময় বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় ডোনাল্ড লু বলে গেছেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুরোপুরি নিখুঁত নয়। এতে দুর্বলতা আছে। সমস্যার বিষয়ে কথা বললে তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য না দিয়ে, খোলামনে কথা বলে সমস্যার সমাধান করাটাই শ্রেয়।
ডোনাল্ড লুর ধারাবাহিকতায় ডেরেক শোলেও নানা বিষয়েই দুই দেশের মধ্যে খোলামেলা আলোচনায় জোর দিয়েছেন। ঢাকায় এসে ডেরেক শোলে বলেছিলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী। এটা ৫১ বছরের শক্তিশালী অংশীদারত্ব এবং আগামী ৫১ বছর এবং তার পরবর্তী সময়ের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। অভিন্ন অনেক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আমাদের একই রকমের অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। সেগুলো নিয়েই আমরা আলোচনা করেছি।’
তবে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের সপ্তাহ দুয়েক আগে র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় নওগাঁয় এক নারীর মৃত্যু, র্যাব নিয়ে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভ্যালের তথ্যচিত্রের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের মন্তব্য এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সবশেষ পরিস্থিতি সরকারের জন্য একধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে।
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক মো. শহীদুল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। এর ভিত্তিতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অনেক সময় এটি সম্ভব হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু এই চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সব সময় থাকে। তবে বাংলাদেশ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত।
সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব মনে করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন করে মেরুকরণের লক্ষ্যে একধরনের ‘প্রতিযোগিতা’ চলছে। যেখানে দুই দেশই বাংলাদেশকে পাশে চায়। ফলে ওয়াশিংটনের বৈঠকটিকে শুধু দ্বিপক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার সুযোগ নেই।