চট্টগ্রামে নিয়মিত আদালতের একই এজলাসে খুন, ধর্ষণ ও অপহরণ মামলার আসামিদের সঙ্গে শিশু আসামিদেরও বিচারকাজ চলে। অথচ শিশু আইন অনুযায়ী, শিশুদের বিচারকাজ হতে হবে আলাদাভাবে; প্রচলিত এজলাসে নয়।
সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে চট্টগ্রামের আদালতে শিশুদের বিচার আলাদাভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আইনজ্ঞ ও মনোবিদেরা মনে করেন, এভাবে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে বিচারকাজ চালানো হলে শিশুদের মনের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি মোড়সংলগ্ন এলাকায় ‘পরির পাহাড়’ নামে পরিচিত এলাকায় আদালত ভবন অবস্থিত। এখানে জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালত, সাতটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসহ ৭৫টি আদালতে বিচারকাজ চলে। নগর ও জেলার ৩৩টি থানা এলাকার শিশু মামলার বিচার সাতটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হয়। আইনজীবীরা বলেন, এখানে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি আসামি মামলার শুনানির জন্য আদালতে হাজির হন। যাঁদের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতি মামলার আসামিও রয়েছেন।
পোশাকধারী পুলিশসহ আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখে শিশুদের মনে ভীতি তৈরি হয়। তাকে ট্রমার মধ্যে থাকতে হয়। তাই শিশু আইন মেনে শিশুদের জন্য আলাদা বিচার কার্যক্রম চালু করা উচিতনুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
আইনি সহায়তা দেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম বলেন, শিশু আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা দাগি আসামিদের সঙ্গে শিশুদের বিচার করার সুযোগ নেই। শিশু আদালত হতে হবে শিশুবান্ধব। যাতে তার মনে কোনো ধরনের প্রভাব না পড়ে।
চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী থানা এলাকার একটি ধর্ষণ মামলায় জামিনে থাকা আসামি মো. আলাউদ্দিন গত ১৩ জুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ এজলাসে হাজির ছিলেন। এক কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়। শুনানিকালে পুরো ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের আইনজীবী। তখন এজলাসে উপস্থিত ছিল ওই কিশোরীও।
একই এজলাসে ইপিজেড থানার ধর্ষণ মামলার আসামি শাহ আলম এবং হালিশহরে দলবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামি সাজ্জাদ হোসেন, আবদুন নুর, নুর উদ্দিন ও নুরু উদ্দিন খান। এ দুই মামলায়ও সাক্ষ্য গ্রহণ হয়।
ধর্ষণের ওই তিন মামলাসহ ওই দিন ট্রাইব্যুনালে মোট ৩২টি মামলার বিচারকাজ হয়। এর মধ্যে আটটি মামলার আসামি ছিল শিশুরা। এদিন ট্রাইব্যুনালে ১৪ জন শিশু-কিশোর উপস্থিত ছিল, যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর।
হালিশহর থানার চুরির মামলায় জামিনে থাকা আসামি ১২ বছরের শিশুর অভিভাবকও এসেছিলেন আদালতে। আদালত প্রাঙ্গণে শিশুটির অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করছি। হাজিরা দিতে এসে ধর্ষণসহ নানা অপরাধের কথা শুনছে শিশু। নিজেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি।’
একই চিত্র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ। গত ১৩ জুন সেখানে আমির হোসেন নামের ধর্ষণ মামলার এক আসামিসহ ২৩ জন আসামির সঙ্গে ১২টি শিশুর মামলার শুনানি হয়, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর।
তিনটি ট্রাইব্যুনালে পেশাগত পোশাক পরা পুলিশ সদস্য ও কোর্ট গাউন পরা আইনজীবীরা ছিলেন। এজলাসও ছিল লালসালু ঘেরা। বাকি চারটি ট্রাইব্যুনালের অবস্থাও একই।
শিশু আদালতে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, শিশুরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকে। অভিভাবকেরাও এর বাইরে নয়। এটি কাটিয়ে উঠতে আলাদা এজলাসের বিকল্প নেই।
শিশু আইনের ১৭ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তা ব্যতীত যত দূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।
২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৮ সালে এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। শিশু আদালতের অধিবেশন ও ক্ষমতা সম্পর্কে আইনের ১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তা ব্যতীত যত দূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।
শিশু আদালতের পরিবেশ ও সুবিধাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে ১৯ ধারায়। ১৯(১) ধারা মতে, শিশু আদালত কক্ষের ধরন, সাজসজ্জা ও আসনবিন্যাস বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে; ১৯ (২) ধারামতে আদালতের আসনবিন্যাস এমনভাবে করতে হবে, যেন সব শিশু বিচারপ্রক্রিয়ায় তাঁর বাবা–মা বা তাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ বা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর, যত দূর সম্ভব, সন্নিকটে বসিতে পারে।
১৯ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করতে পারবেন না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত প্রবেশন কর্মকর্তা পারুমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, অন্য অপরাধীদের সঙ্গে শিশু আসামিদের বিচার না করে শিশু (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুসারে আলাদা এজলাসে শিশুবান্ধব পরিবেশে বিচারকার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬–এর সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশু আসামিদের অন্য আসামিদের সঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় না। তবে এজলাসে একসঙ্গে থাকে। অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে শিশুদের বিচার আলাদাভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না।
আলাদা এজলাস না থাকায় শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায় না বলে মন্তব্য করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর সরকারি কৌঁসুলি এম এ নাসের।
আরেক কৌঁসুলি নিখিল কুমার নাথও বললেন একই কথা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ৪–এর এই সরকারি কৌঁসুলি বলেন, শিশু আইন অনুযায়ী শিশু আদালতে বিচার করা বিদ্যমান বাস্তবতায় কঠিন। অবকাঠামোগত সংকট দূর করতে হবে।
দাগি অপরাধীদের সঙ্গে বিচার কার্যক্রম চলার কারণে শিশুদের মনে প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকধারী পুলিশসহ আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখে শিশুদের মনে ভীতি তৈরি হয়। তাকে ট্রমার মধ্যে থাকতে হয়। তাই শিশু আইন মেনে শিশুদের জন্য আলাদা বিচার কার্যক্রম চালু করা উচিত।