ডোনাল্ড লু
ডোনাল্ড লু

সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড লু

বাংলাদেশকে নিজের চোখ দিয়ে দেখে যুক্তরাষ্ট্র

৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ঘিরে গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। অতীতের সেই মতপার্থক্যকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সামনে এগিয়ে যেতে চায়। তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধের বিষয়গুলো সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অটুট থাকবে।

ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন।

প্রথম আলো এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র বিক্ষোভ, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবসহ নানা বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

প্রশ্ন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দুই দেশ সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দিচ্ছে। বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। সুশাসন ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোকে সম্পর্কের অস্বস্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি বিষয়গুলোকে এক পাশে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

ডোনাল্ড লু: নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটারদের ওপর বলপ্রয়োগ করায় আমরা পুলিশ, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলাম।

আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অর্থপূর্ণ সংলাপে বসতে বলেছিলাম। আমরা সভা-সমাবেশ ও বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলাম। এটা খুবই স্বাভাবিক। সব অঞ্চলেই আমরা এমন করি। বাংলাদেশে এসব মূল্যবোধ বজায় রাখতে আমরা কাজ করে যাব।

আমাদের সম্পর্কের মাঝে অনেক জটিল বিষয় রয়েছে। গত বছর নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে অনেক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল, এটা তো এখন আর গোপন নয়। র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি। ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন নিয়েও কথা বলেছি। বিষয়গুলো তো জটিল। যেমন শ্রম অধিকারের মতো বিষয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। এতে অগ্রগতি খুব ধীরগতির। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে সময় লাগে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বলেছি, জটিল বিষয়ের পাশাপাশি আসুন সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করি। আসুন ইতিবাচক অ্যাজেন্ডা খুঁজি। আমার বিশ্বাস, আমরা যদি ইতিবাচক বিষয় নিয়ে কাজ করি যেমন যুক্তরাষ্ট্রে যদি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানো হয়, ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবসা ও বিনিয়োগ হয়, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য পথ তৈরি করা যায়, যাতে বাংলাদেশের পরিবেশের উন্নতি হয় আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা যায়; আমরা যদি এ বিষয়গুলো করতে পারি, তবে তা জটিল বিষয়গুলো সমাধানের পথ আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশ বিচারবহির্ভূত হত্যা কমানোর জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, সেটা প্রত্যাহারের সবশেষ অগ্রগতি কী?

ডোনাল্ড লু: র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে। এক বছর আগে বাংলাদেশ সফরের সময় র‌্যাবের বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত বছর তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, র‌্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। এটা বিরাট ঘটনা। এটা অবশ্যই ভালো অগ্রগতি উল্লেখ করেই বলতে চাই, আমাদের এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে। আমরা দেখছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য বিভাগের সদস্যরা এসব অপরাধ করে চলেছেন। র‍্যাবের অতীতের অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না, সেটাও আমরা দেখতে চাই। এ বিষয়গুলো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি যে বাংলাদেশ সরকারের (র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার) প্রক্রিয়া নিয়ে ধৈর্যের অভাব আছে। গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত যে র‌্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন না করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে।

প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ অভিযোগ করে আসছে। বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপট থেকে মার্কিন প্রশাসন কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

ডোনাল্ড লু: যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করা উচিত যে আমাদের দেশেও মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা আছে; এটা সত্যি। বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে আমরা সেটি নিয়ে কথা বলি। কারণ, বাংলাদেশকে আমাদের সহযোগী মনে করি। তারা যদি আমাদের কোনো সমস্যা দেখে, তাহলে তারাও আমাদের সেটা বলবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমার দুই সন্তান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে, তা নিয়ে তারা আমার কাছে অনেক অভিযোগ করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল-গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের দেশে হাজার হাজার বিক্ষোভ হয়েছে। মোটামুটি সব বিক্ষোভই শান্তিপূর্ণ হয়েছে। তাদের বিক্ষোভ করতে দেওয়া হয়েছে। আমরা সাধারণত সভা-সমাবেশ ও বাক্‌স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে কিছু কিছু বিক্ষোভকারী সহিংসতা ও ভাঙচুরে লিপ্ত হয়েছে। অনেকে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের কোনো স্থান নেই। এসব ঘটনায় পুলিশ হস্তক্ষেপ করেছে। কোথাও কোথাও গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। আমি জানি, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কেউ কেউ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এসব ঘটনায় পুলিশ অতি উৎসাহী হয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে থাকলে সেটি তদন্ত করা হবে। যদি কোনো পুলিশ সদস্য অতি উৎসাহী হয়ে এমন কিছু করে, তাহলে তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। এটাই গণতন্ত্রে হয়। আমাদের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাই।

ডোনাল্ড লু
প্রশ্ন

বাংলাদেশের একটি বিরোধী দল বিএনপি অভিযোগ করেছে, ভারতের মধ্যস্থতায় প্রভাবিত হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান নরম করেছে। বিএনপির নেতাদের এসব দাবির বিষয়ে আপনার মতামত কী?

ডোনাল্ড লু: অভিযোগটি হাস্যকর। আমরা বড় দেশ। সারা বিশ্বেই আমরা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। যুক্তরাষ্ট্র কী করবে, সে বিষয়ে কেউ আমাদের পরামর্শ দেয় না। ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে কী করতে হবে, সেটিও আমরা বলি না। কাজেই অন্য দেশ যেভাবে বলেছে বা যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে আমরা কাজ করেছি বলে যে ধারণা, সেটা একেবারেই সত্যি নয়। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আমরা অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথাও আমরা বলেছিলাম। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে গত বছর আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটারদের ওপর বলপ্রয়োগ করায় আমরা পুলিশ, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি আরোপ করেছিলাম। আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অর্থপূর্ণ সংলাপে বসতে বলেছিলাম। আমরা সভা-সমাবেশ ও বাক্স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলাম। এটা খুবই স্বাভাবিক। এ অঞ্চলে আমরা এটা করি। বাংলাদেশে এসব মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে ঢাকার প্রতি পদক্ষেপকে ওয়াশিংটন দিল্লির চোখ দিয়ে দেখে। সম্প্রতি ভারতের এক কূটনীতিক বলেছেন, তাঁর দেশের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের ওপর চাপ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ডোনাল্ড লু: যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখে। চীন, ভারত কিংবা রাশিয়ার স্বার্থের দৃষ্টিকোণ দিয়ে নয়। বাংলাদেশে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি আলোচনা হয়। আমি মনে করি, সেটি ফলপ্রসূ ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। তবে এটাও সত্যি যে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত আলোচনা করছে। তারা সব সময় আলোচনা করে। এ অঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা কথা বলি। সেই আলোচনায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ—কখনো কখনো বাংলাদেশ প্রসঙ্গও থাকে।

আমি বলব, যুক্তরাষ্ট্র মাঝেমধ্যে ভারতের নীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। আবার কখনো কখনো ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে প্রভাব ফেলে। আর এটাকে আমরা কূটনীতি বলি। এটা আমরা এ অঞ্চলের সব দেশের ক্ষেত্রেই করি; যেটা স্বাভাবিক বটে। আমরা বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই দেখি।

প্রশ্ন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা বিশ্বে চীনের প্রভাব বাড়ছে। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে এমন ঘটনারই প্রতিফলন ঘটেছে। অঞ্চলে ও পথের উদ্যোগের (বিআরআই) সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর চীন এখন বাংলাদেশের সঙ্গে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই) এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ (জিএসআই) সই করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাবকে কীভাবে মূল্যায়ন করে?

ডোনাল্ড লু: আমরা সব সময় আমাদের সহযোগীদের তারা কাকে পছন্দ করবে, সে বিষয়ে কিছু বলি না। আমরা চীনসহ সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্পর্ক রাখার কথা বলি। আমরা স্বাভাবিক সম্পর্কের কথাই বলি। সে সম্পর্কের কথা বলি না, যেটা চাপ কিংবা অস্বাভাবিক ঋণের শর্তে গড়া। সেই দেশগুলোতে চীনের সুসম্পর্ক বা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে, যেখানে অন্য দেশগুলো প্রতিযোগিতা করতে পারে।

আমি যখন কিরগিজস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলাম, তখন দেখেছি চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ সেখানে বিনিয়োগ করতে প্রতিযোগিতায় নামত না। শুধু চীন সেখানে বিনিয়োগ করেছে। তারা সেখানে বেশ কিছু বাজে প্রকল্প নিয়েছে। বিপুল বিনিয়োগে করা প্রকল্পগুলো কিরগিজ জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনেনি।

অপর দিকে কাজাখস্তানে পশ্চিমা দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র—সবাই প্রতিযোগিতা করছে। নেদারল্যান্ডস সেখানকার শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। চীনের অবস্থান অষ্টম। তারা সেখানে স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতা করছে। তাদের প্রকল্পে কাজাখস্তানের জনগণ কাজ করছে, সেখানে চীনের কোনো শ্রমিক নেই।

চীনের সবাই বলেছে, বাংলাদেশে আমরা ভালো সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারি। এ জন্য আমরা বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, আইডিয়া, শিক্ষার মতো ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করার প্রস্তাব দিয়েছি।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

ডোনাল্ডলু: আপনাকেও ধন্যবাদ।