মাউশির প্রতিবেদন

এক বছরে মাধ্যমিকের ৪৭ হাজার ছাত্রীর বাল্যবিবাহ

২০২১ সালে বার্ষিক পরীক্ষায় পৌনে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে শিশুশ্রমে যুক্ত ৭৮ হাজার।

  • দেশে ২০ হাজার ২৯৪ বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১ হাজার ৬৭৯টির তথ্য পাওয়া গেছে।

  • বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম সবচেয়ে বেশি রাজশাহী অঞ্চলে।

  • পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। বাকিদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখা দেশের ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে দেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২০ হাজার ২৯৪টি।

এর আগে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ব্যানবেইসের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৫২ হাজার। অর্থাৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৬২ হাজার।

এখন পরামর্শ থাকবে, মাউশির এই তথ্যের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে শিখনঘাটতি পূরণ এবং পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা। তবে সেটি যেন গতানুগতিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

মাউশি দেশের সব বিদ্যালয়ের কাছেই তথ্য চেয়েছিল। তবে তথ্য দিয়েছে ১১ হাজার ৬৭৯টি। এগুলোয় গত বছর মোট শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ৬৬ লাখ ৫০ হাজার, যা ২০২০ সালে ছিল ৬৫ লাখ ৫৬ হাজার। এই তথ্য বলছে, বিদ্যালয়গুলোয় করোনার মধ্যেও প্রায় ৯৩ হাজার বেড়েছে শিক্ষার্থী।

করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস–পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। টানা প্রায় ১৮ মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে সশরীর ক্লাস শুরু হয়। করোনার কারণে গত বছরের নভেম্বরে মাধ্যমিকে (ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি) বার্ষিক পরীক্ষা এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষা হয় মাত্র তিন বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ গণিত)।

মাউশি বলছে, গত বছর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল প্রায় ৬১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। অনুপস্থিত ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫৫ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহ ও ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ শিশুশ্রমে যুক্ত হওয়ায় বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।

সাধারণ নিয়ম হলো, বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই পরবর্তী ক্লাসে উঠতে পারে। ফলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বড় অংশেরই ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

অবশ্য মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সবাই ঝরে যাবে বলে তাঁরা মনে করছেন না। বাল্যবিবাহ শুধু অশিক্ষিত ও দরিদ্র পরিবারেই হয় না, শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরাও বাল্যবিবাহের শিকার হয়। অনেকে বিয়ের পর ফিরে আসে। আবার মৌসুমি কাজে অনেক শিক্ষার্থী মা–বাবাকে সহায়তা করে বা এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গিয়ে অর্থের বিনিময়ে শ্রম দেয়। তাদের অনেকেই ফিরে আসবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বেশি রাজশাহীতে

দেশে মাউশির নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। মাউশির প্রতিবেদন বলছে, বার্ষিক পরীক্ষায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার (৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ) বেশি, বরিশাল অঞ্চলে অনুপস্থিতির হার সবচেয়ে কম (৬ দশমিক ৬২ শতাংশ)।

বাল্যবিবাহের কারণে অনুপস্থিতির হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী অঞ্চলে (১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ), সবচেয়ে কম সিলেট অঞ্চলে (৪ দশমিক ৩০ শতাংশ)।

সম্প্রতি মাউশি সূত্রে জানা যায়, সিলেটের জৈন্তাপুরের শাড়িঘাট হাইস্কুলে ২০২০ সালে ৭৪৬ শিক্ষার্থী ছিল। ২০২১ সালে শিক্ষার্থী কমে দাঁড়ায় ৬৮৪ জনে। বিদ্যালয়টির ১৪ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে।

শিশুশ্রমে যুক্ত শিক্ষার্থীও রাজশাহী অঞ্চলে বেশি। এ কারণে এই অঞ্চলে প্রায় ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। কম চট্টগ্রাম অঞ্চলে (প্রায় ১৩ শতাংশ)।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, নাগরিক সমাজ ও গবেষকদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ ছিল করোনার মধ্যে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বাড়তে পারে।

মাউশির তথ্য বলে দিচ্ছে, উদ্বেগটি বাস্তব ছিল। এখন পরামর্শ থাকবে, মাউশির এই তথ্যের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে শিখনঘাটতি পূরণ এবং পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা। তবে সেটি যেন গতানুগতিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।