তীব্র তাপপ্রবাহের দিনগুলোতে অসুস্থতা ও মৃত্যু বেড়ে যায়। এ বছরও হাসপাতালে রোগী বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দেশের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন।
গতকাল রোববার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা শেষে সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, দাবদাহ চলছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। এখন যাদের হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার নেই, তাদের যেন ভর্তি করা না হয়। তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হতে পারে। কারণ, আমরা বাচ্চাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলব না।’
উষ্ণতাজনিত অসুস্থতা চিকিৎসার নির্দেশিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ সোমবার এই নির্দেশিকা ব্যবহারে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবে অধিদপ্তর। এরপর ২৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশের চিকিৎসকদের পর্যায়ক্রমে জুমের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে।
উষ্ণতাজনিত অসুস্থতা চিকিৎসার নির্দেশিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ সোমবার এই নির্দেশিকা ব্যবহারে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবে অধিদপ্তর।
ইউনিসেফের সহায়তায় তৈরি করা ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, গরম আবহাওয়া ও তাপ প্রবাহের কারণে মানুষের রোগগ্রস্ততা ও মৃত্যু বাড়ে, অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভের ক্ষতি হয়, মানসিক চাপ বাড়ে, কায়িক পরিশ্রমের ক্ষমতা কমে যায় এবং পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। ওই নির্দেশিকাতেই বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহের দিনগুলোতে দেশে মৃত্যু বেড়ে যায়।
মার্চ মাস যেতে না যেতেই দেশের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পড়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষ না হতেই এক সপ্তাহ ধরে মানুষের মুখে তীব্র গরমের কথা শোনা যাচ্ছে। সকাল না হতেই খাঁ খাঁ রোদ্দুর। মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে চাইছে না। বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। রিকশাওয়ালা, কৃষক অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছেন। কিছু কিছু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
যশোর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, পাবনা, বরিশালের প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে এসব জেলার সরকারি হাসপাতালে রোগী বেড়েছে। রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটেও রোগীর বাড়তি চাপ দেখা গেছে।
ইউনিসেফের সহায়তায় তৈরি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, গরম আবহাওয়া ও তাপ প্রবাহের কারণে মানুষের রোগগ্রস্ততা ও মৃত্যু বাড়ে, অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভের ক্ষতি হয়, মানসিক চাপ বাড়ে, কায়িক পরিশ্রমের ক্ষমতা কমে যায় এবং পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। তাপপ্রবাহের দিনগুলোতে দেশে মৃত্যু বেড়ে যায়।
প্রচণ্ড তাপ বা উষ্ণতা স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলে তার সচিত্র বর্ণনা আছে নির্দেশিকায়। তাতে বলা আছে: তাপের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, ক্লান্তিবোধ হয়, বমি বমি ভাব দেখা দেয়, জ্বর হয়, হঠাৎ রক্তচাপ কমে যায়। এর বাইরে গর্ভবতী নারীদের জন্য বাড়তি কিছু সমস্যা আছে: এতে গর্ভস্থ সন্তান অপুষ্টির শিকার হয়, সময়ের আগে প্রসব হওয়ার ঝুঁকি থাকে এবং মৃত সন্তানের জন্ম হতে পারে।
ওই নির্দেশিকায় ২০১৭ সালের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা আছে, তীব্র তাপপ্রবাহের দিনগুলোতে মৃত্যু ২২ শতাংশ বেড়ে যায়।
মূলত ওই গবেষণা করেছিল আমেরিকান মেট্রোলোজিক্যাল সোসাইটি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, নেদারল্যান্ডসের রেডক্রস রোড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টারের পাঁচজন গবেষক এই গবেষণা করেছিলেন। তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড মেটোরোলজি আন্ড ক্লাইমেটোলোজিতে ছাপা হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে।
পরিস্থিতি বুঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হতে পারে। কারণ, আমরা বাচ্চাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলব না।সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী
গবেষকেরা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩৫টি আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পেল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের (এসভিআরএস) জন্মমৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করেন। এই পর্যালোচনায় গবেষকেরা ১৯৮৯ থেকে ২০১১ সালের তথ্য নিয়েছিলেন।
আবহাওয়াবিদ্যায় হিটওয়েভ বা তাপপ্রবাহের সংজ্ঞা আছে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী ২২ বছরে কতটা তাপপ্রবাহ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গেছে, সেই সংখ্যা তাঁরা বের করেছেন। তাপপ্রবাহের দিনগুলোর মৃত্যুর সংখ্যাও তাঁরা হিসাবে নিয়েছেন এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রার দিনগুলোর মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তাপপ্রবাহের সময় ২২ শতাংশ মৃত্যু বেশি হয়। গবেষকেরা অবশ্য এই হিসাবের মধ্যে মাতৃমৃত্যু ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
তাপপ্রবাহে মৃত্যু যে বাড়ে, তা নিয়ে আরও গবেষণা আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশিকায় অন্য একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তাপের কারণে দেশে ১ থেকে ৩ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছিল।
সামন্ত লাল সেন গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের হিটস্ট্রোক কী, তা বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, হিটস্ট্রোকের লক্ষণ হচ্ছে হঠাৎ বা দ্রুত শরীরের তাপ বেড়ে যাওয়া, অচেতন হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, তীব্র মাথাব্যথা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, পেশিতে টান পড়া। এ হিটস্ট্রোক হলে শরীরে ঘাম কমে যায়, বমি হয়, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, মানসিক বিভ্রম দেখা দেয়, খিঁচুনি দেখা দেয়।
এ ধরনের রোগীদের কী চিকিৎসা দিতে হবে, তা প্রতিটি হাসপাতালকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামন্ত লাল সেন বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অপেক্ষাকৃত শীতল ঘরে বা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিতে হবে, রোগীর শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় কাপড় খুলে ফেলতে হবে, রোগীর শরীরে বাতাস করতে হবে, কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে গা মোছাতে হবে, বগল, ঘাড়, কুঁচকিতে আইস প্যাক ব্যবহার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্দেশনা আমরা প্রতিটি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
নির্দেশিকার শেষ দিকে সাধারণ মানুষের করণীয় বিষয়ে বলা আছে। দিনে আড়াই থেকে তিন লিটার নিরাপদ পানি পান করতে হবে, অস্বাস্থ্যকর পানীয় ও খাবার খাওয়া যাবে না, প্রয়োজনে দিনে একাধিকবার গোসল করতে হবে, গরমের সময় ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে, গাঢ় রঙিন পোশাক পরা থেকে বিরত থাকতে হবে, প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না, কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে হবে। কারও যদি অন্য কোনো অসুখ থাকে, তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।