সড়কে জন্ম নেওয়া সেই ফাতেমা কোলে চড়তে চায়

ফাতেমাকে আদর করছে তার বোন জান্নাত
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ট্রাকচাপায় রহিমা আক্তার মারা যাওয়ার আগে সড়কে জন্ম দিয়েছিলেন ফাতেমাকে। ফাতেমার জন্মটাই সবার কাছে এখনো এক বড় বিস্ময়। ফাতেমা চোখ মেলে পৃথিবীর আলো দেখতে দেখতে ততক্ষণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ফাতেমার মা, বাবা জাহাঙ্গীর আলম ও বোন সানজিদা। ১৫ দিন বয়স থেকেই ফাতেমার ঠাঁই হয় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসে। চারপাশে রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই ফাতেমার, তা বোঝার বয়স হয়নি। সে কোলে চড়তে পছন্দ করে, আদর চায়। চায় মমতার স্পর্শ।

গত ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ট্রাকচাপায় একসঙ্গে তিনজনের মারা যাওয়া ও ফাতেমার জন্ম দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। বর্তমানে রাজধানীর আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসে একটু একটু করে বড় হচ্ছে ফাতেমা। দোলনায় শুইয়ে রাখলে কোলে চড়ার বায়না করে। বুকে হাত রাখলে কান্না থেমে যায় তার।

ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম রানু বলেন, নিবাসের অন্যরাও কোলে চড়তে চায়। তবে ফাতেমা একটু বেশি কোলে চড়তে চায়। হাতের স্পর্শ খুঁজতে থাকে। সে নিরাপদে আছে, এটা নিশ্চিত করতেই হয়তো সে এগুলো খোঁজে। নিবাসের কর্মীদের মধ্যে যাঁরা একটু বয়স্ক, তাঁরা ফাতেমাকে কোলে নিয়ে ‘নানু নানু’ বলে খেলছিলেন। তখন ফাতেমার মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। তবে সে বেশির ভাগ সময়ই কিছুটা গম্ভীর থাকে।

সড়কে জন্ম নেওয়া ফাতেমা এখন হাসে, খেলে। ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগমের কোলে ফাতেমা

আজ মঙ্গলবার দুপুরে নিবাসে গিয়ে দেখা যায়, ফাতেমাকে দেখতে এসেছেন ফাতেমার দাদা মোস্তাফিজুর রহমান, দাদি সুফিয়া বেগম ও পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া বড় বোন জান্নাত। নিবাসের অফিসকক্ষে দাদা–দাদির সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলে ফাতেমা। জান্নাত কোলে নিয়ে আদর করে। তবে ক্ষুধা লাগার পাশাপাশি ঘুমের সময় হওয়ায় কান্না শুরু করে।

ফাতেমার নাম রেখেছে তার বোন জান্নাত। জান্নাত ফাতেমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। সে বলল, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সে ঠিকই ফাতেমাকে দেখে রাখতে পারবে।

ফাতেমার বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪২) পেশায় কৃষক ছিলেন। বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রায়মনি এলাকায়। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা। ত্রিশাল উপজেলার কোর্ট ভবন এলাকায় সড়কের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বা সড়ক পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁরা।

সড়কে জন্মের সময় ফাতেমা হাতে ব্যথা পেয়েছিল। গালে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে এখন হাতে তেমন কোনো ব্যথা নেই। হাত–পা নেড়ে দোলনায় শুয়ে খেলছিল ফাতেমা। আজ ফাতেমার ওজন ছিল ৪ কেজি ৫০০ গ্রাম। তবে এর আগে ওজন পাঁচ কেজি ছাড়িয়েছিল বলে জানালেন নিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।

ফাতেমা এখন হাসে, খেলে

ছোটমণি নিবাসে মা-বাবার পরিচয়হীন শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী পরিত্যক্ত বা পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া, বাবা ও মায়ের আদালতে মামলা চলছে—এমন শিশুদের রাখা হয়। কিন্তু ফাতেমার সব পরিচয় থাকার পরও থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার কথা চিন্তা করে তাকে ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলা প্রশাসন। আজ নিবাসে ফাতেমাসহ ছিল ২৬ শিশু।

ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম আদর করছেন ফাতেমাকে

আজ ছোটমণি নিবাসে বসেই কথা হয় ফাতেমার দাদা মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ২০০৪ সালে হারিয়েছেন ১৩ বছর বয়সী এক ছেলেকে। গত বছর হারালেন এক ছেলে, ছেলের বউ ও এক নাতনিকে। ১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোস্তাফিজুর রহমানের এক ভাই। তাঁর আপন তিন মামাও মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ফলে রাস্তায় বের হলে এই পরিবারের সদস্যরা আবার কী ঘটে, এ আশঙ্কায় থাকেন। তবে ফাতেমার জন্মের পর থেকে তাঁদের ঘরে বসে থাকার উপায় নেই। মাসে একবার বা দুবার ঢাকায় ফাতেমাকে দেখতে আসতে হচ্ছে।

মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, ত্রিশাল থেকে ঢাকা, তিন থেকে চারজনের যাতায়াত খরচের পাশাপাশি ঢাকায় খাওয়াদাওয়া করলে খরচ আরও বাড়ে। কোনো কোনো সময় ঢাকায় নিবাস পর্যন্ত পৌঁছাতেই লেগে যায় চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা। আবার ফেরার সময় একই ঝক্কি সামলাতে হয়।

ফাতেমাকে কেমন দেখলেন, জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, এখন তো মনে হচ্ছে, ভালোই আছে। তবে প্রথম দিকে নিবাসের কর্মীরা একটু খারাপ ব্যবহার করতেন বলেও অভিযোগ করলেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুফিয়া বেগম শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁদের দুই ছেলেই মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফাতেমার বোন জান্নাত ও প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরেক ভাই এবাদুল্লাহকে দেখার জন্য এক মেয়েকে বাড়িতে এনে রেখেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। বাড়ির জায়গা নিয়ে মামলা–মোকদ্দমা চলায় নতুন করে বাড়ি করতে পারছেন না।

ফাতেমাকে আদর করতে করতেই মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, নতুন বাড়ি করেই তিনি ফাতেমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। দুর্ঘটনায় ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনি মারা যাওয়া এবং আরেক নাতনির জন্ম হওয়ায় তিনি দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই জেলা প্রশাসককে বলেছিলেন, ফাতেমা ভালো থাকবে, এমন একটি জায়গায় রাখার জন্য। তবে এখন ভাবছেন, ফাতেমাকে আর বেশি দিন দূরে রাখবেন না। আর তাঁর পক্ষে ঢাকায় এসে নাতনিকে দেখাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

দাদা, দাদি ও বোনের সঙ্গে ফাতেমা

পাশে বসা ফাতেমার দাদি সুফিয়া বেগম বললেন, ছেলে জাহাঙ্গীর সব সময় সতর্ক করতেন, তিনি যাতে বাড়ির কাছে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে সড়কের খুব কাছে না যান। অথচ সেই ছেলেই বউ–বাচ্চা নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনাতেই মারা গেলেন। তিনিও বললেন, ফাতেমাকে দেখে সে ভালো আছে বলেই মনে হচ্ছে।

আলাপে জানা গেল, ফাতেমার বাবা জাহাঙ্গীরের যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন জাহাঙ্গীরের মা জাহাঙ্গীরসহ চার সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। তারপর সুফিয়া বেগমকে বিয়ে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনিই জাহাঙ্গীরসহ অন্য সন্তানদের বড় করেছেন।

মোস্তাফিজুর রহমান সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পান। এ ছাড়া তিনি বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকান চালান। ফাতেমার জন্মের পর ফাতেমার দাদা হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমানের পরিচিতি বেড়েছে।

সড়কে ফাতেমার জন্মের পর নবজাতককে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও তার কল্যাণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ১৮ জুলাই আইনজীবী কানিজ ফাতিমা তুনাজ্জিনা হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। গত ৩০ আগস্ট ফাতেমার আইনগত অভিভাবক হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমানকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে সড়ক পরিবহন আইনের ৫৪ ধারা অনুসারে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড। ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক বাড়ি করার জন্য আরও পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে বলে জানালেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানালেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান ওই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি মাসের খরচ হিসেবে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা তুলে সংসার চালান।

মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ফাতেমা এখন আর শুধু তাঁর নাতনি নয়, বাংলাদেশের মানুষ চেনে ফাতেমাকে। ফাতেমার জন্যই তিনি যেখানে যান, সেখানেই একটু বাড়তি সম্মান পান। এর আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় মোস্তাফিজুর আপনজনকে হারিয়েছেন, তবে ফাতেমার জন্যই দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে আর্থিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন।