চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রধারী শনাক্ত হয়, ব্যবস্থা নেয় না

গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে এক কর্মীকে কোপানোর জেরে আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ।

রামদা হাতে ছাত্রলীগ কর্মী নাইম আরাফাত। বৃহস্পতিবার শাহজালাল হলের সামনে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হলেই প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র হাতে দেখা যায় নেতা-কর্মীদের। এর মধ্যে অন্তত ১৩ জন অস্ত্রধারী শনাক্ত হলেও কর্তৃপক্ষ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। গত আট মাসে ছাত্রলীগের তিনটি সংঘর্ষের ঘটনায় ধারালো অস্ত্র হাতে থাকা নেতা-কর্মীদের শনাক্ত করা হয়। শনাক্ত হওয়া নেতা-কর্মীরা এখনো হলেই আছেন।

সর্বশেষ গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার ছাত্রলীগের তিনটি পক্ষের মধ্যে চার দফা সংঘর্ষের সময় অন্তত ৮০ জনকে ধারালো অস্ত্র হাতে দেখা যায়। সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৪৪ জন। এর মধ্যে গতকাল রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এক কর্মীকে কোপানোর জেরে আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ।

গত আট মাসে ছাত্রলীগের তিনটি সংঘর্ষের ঘটনায় ধারালো অস্ত্র হাতে থাকা নেতা-কর্মীদের শনাক্ত করা হয়। শনাক্ত হওয়া নেতা-কর্মীরা এখনো হলেই আছেন।

সংঘর্ষের সময় রামদা হাতে থাকা যে ১৩ নেতা-কর্মীর নাম ও পরিচয় উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির পদধারী নেতা রয়েছেন ৪ জন—খালেদ মাসুদ, সুলতান মাহবুব, রুবেল মিয়া ও আরাফাত রায়হান। বাকিরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের কর্মী। তাঁরা হলেন নাইম আরাফাত, সাব্বির হোসেন, মোহাম্মদুজ্জামান ওমর, মোহাম্মদ সফল, মোহাম্মদ শামীম, ইমন আহমেদ, মেহেদী হাসান, মোহাম্মদ হোসাইন ও আহমেদ অনিক।

অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের দুটি ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন পাইনি। এবারের ঘটনায় প্রথম আলোর সংবাদ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এবার অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যেসব অস্ত্রধারী চিহ্নিত হয়েছে, তাদের ধরতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল, আশপাশের এলাকা ও বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জেলা বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আরিফ হোসেন

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা নতুন নয়। গত পাঁচ বছরে অন্তত ১৬৫ বার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। হলের কক্ষ দখল, আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে চেয়ারে বসা, ফেসবুক পোস্ট-কমেন্টসহ তুচ্ছ সব কারণে এসব সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয়েছেন চার শতাধিক নেতা–কর্মী। ভাঙচুর করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের কক্ষসহ বিভিন্ন স্থাপনা। তবে এখন পর্যন্ত এসব নিয়ে মামলা করেনি কর্তৃপক্ষ।

গত আট মাসের যে তিন ঘটনায় ধারালো অস্ত্রধারীরা শনাক্ত হয়েছে, তার প্রথমটি ঘটে গত বছরের ১ জুন। ওই সময় শনাক্ত হয় তিনজন। পরের ঘটনা হয় গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর। তখন শনাক্ত হয় তিনজন। সর্বশেষ বুধবার থেকে শুক্রবারের সংঘর্ষে শনাক্ত হয়েছে আটজন।

চট্টগ্রাম জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জেলা বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেসব অস্ত্রধারী চিহ্নিত হয়েছে, তাদের ধরতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল, আশপাশের এলাকা ও বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।

আমরা হুট করেই কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমাদের কিছু পর্ষদ আছে, সেগুলোর মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হয়।
উপাচার্য শিরীণ আখতার

তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত তিন বছরে মারধর ও সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের ৩১ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে। একটি বহিষ্কারাদেশও কার্যকর হয়নি। বহিষ্কৃত হয়েও নেতা-কর্মীরা আবাসিক হলে থেকেছেন। এমনকি ক্লাস-পরীক্ষা দিয়ে সনদও পেয়েছেন। এর মধ্যে ২৩ জনকে মানবিক কারণ দেখিয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে কর্তৃপক্ষ। এই শাস্তির মধ্যে চিহ্নিত অস্ত্রধারী ছিলেন শুধু দুজন—খালেদ মাসুদ ও আরাফাত রায়হান। তাঁদের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করা হয়।

এবারের সংঘর্ষের ঘটনায়ও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে কর্তৃপক্ষ। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার বলেন, ‘আমরা হুট করেই কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমাদের কিছু পর্ষদ আছে, সেগুলোর মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হয়।’

অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটত না।