নির্বাচন কমিশন

ইভিএম নিয়ে দলগুলোর বক্তব্য পাল্টে দিল ইসি

ইসির সঙ্গে জুলাই মাসে সংলাপে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছিল মাত্র চারটি দল। কিন্তু কর্মপরিকল্পনায় ইসি বলেছে, পক্ষে ১৭টি দল।

  • ইসি বলছে, জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংলাপে অংশ নেওয়া ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি দল কোনো না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে ছিল।

  • যে ১৭টি দলকে ইভিএমের পক্ষে বলছে ইসি, তার মধ্যে তিনটি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে। একটি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দেয়নি। ৯টি দল ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন শর্তের কথা বলেছে।

ইভিএম নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের বিশেষ আগ্রহ নতুন কিছু নয়

বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিপক্ষে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের দাবি, বেশির ভাগ দল ইভিএমের পক্ষে। এ কারণেই সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এটি করতে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যকে নিজেদের মতো করে পাল্টে নিয়েছে সাংবিধানিক এই সংস্থা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গত বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেখানে তারা উল্লেখ করেছে, গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংলাপে ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে, এর মধ্যে ১৭টি দলই কোনো না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে ছিল। সরাসরি ইভিএমের পক্ষে ছিল ১২টি দল। কিন্তু সংলাপে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত প্রস্তাব পর্যালোচনা এবং দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ইসি যে ১৭টি দলকে ইভিএমের পক্ষে বলে প্রচার করেছে, তার মধ্যে ৩টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে। ১টি দলের ইভিএম নিয়ে কোনো মতামত ছিল না। আর ৯টি দল ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন শর্তের কথা বলেছিল। সরাসরি ইভিএমের পক্ষে অবস্থান ছিল মাত্র চারটি দলের। এই চারটি দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ, তরীকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল এবং বিকল্পধারা। এর মধ্যে তরীকত ও সাম্যবাদী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। বিকল্পধারার সঙ্গে একধরনের নির্বাচনী সমঝোতা ছিল গত সংসদ নির্বাচনে।

ইসি কর্মপরিকল্পনায় দাবি করেছে, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সরাসরি ইভিএমের পক্ষে। কিন্তু গত ১৮ জুলাই দলটি সংলাপে ইসিকে যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে তারা ইভিএমের সরাসরি বিরোধিতা করেছিল। দলটি ইসির কাছে যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে ইভিএম প্রসঙ্গে বলা হয়, ইভিএম মেশিনে নয়, বরং স্বচ্ছ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসি এই দলের অবস্থান নিজেদের মতো করে পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে তাঁদের দল। এটি তাঁরা সংলাপে লিখিতভাবে এবং মৌখিকভাবে ইসিকে জানিয়েছিলেন।

ইসি তাদের কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে। ১৯ জুলাই সংলাপে অংশ নিয়ে দলটি ইসিকে যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানে ইভিএমের বিষয়ে কিছু ছিল না; বরং তাদের প্রস্তাব ছিল ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে করা’।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জালাল উদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ইসির সংলাপে স্পষ্ট বলেছেন, তাঁরা ইভিএমের বিপক্ষে। ব্যালটে ভোট চান তাঁরা। এখন যদি ইসির প্রকাশনায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ইভিএমের পক্ষে বলা হয়, তাহলে সত্য লেখেনি। এটি নিন্দনীয়। তিনি বলেন, বেশির ভাগ দল ইভিএমের বিপক্ষে। ইসি সংলাপে বলেছিল, দলগুলোর মতামত গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তারা সেটি করেনি।

ইসি তাদের কর্মপরিকল্পনায় বলেছে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন শর্তসাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে। তবে গত ২৪ জুলাই সংলাপে অংশ নিয়ে দলটি ইসিতে যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল, তার অনুলিপি সাংবাদিকদেরও দিয়েছিল। সেটাতে ইভিএম প্রসঙ্গে দলটির দেওয়া প্রস্তাবের শিরোনাম ছিল, ‘ইভিএম ব্যবহার না করা’। সেখানে তারা বলেছিল, ‘ইভিএমের ব্যাপারে জনগণের স্বচ্ছ ধারণা নেই। ইতিমধ্যেই দেশ-বিদেশে এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আর ইভিএম সম্বন্ধে আমাদের দেশের মানুষ বিশেষত গ্রামবাংলার মানুষ অজ্ঞ। তাই এটি ব্যবহার করা হলে অনেকের ভোট দেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অতএব জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।’

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। এই মতামত তাঁরা লিখিতভাবেই ইসিকে দিয়েছিলেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাল্টে দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান (সিইসি অসুস্থ থাকায় এখন তিনি সিইসির দায়িত্বে) এবং মো. আলমগীরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন এত সন্দেহ, অবিশ্বাস—এ বিষয়ে প্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের ইভিএমের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এতে ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল বা ভিভিপিএটি নেই। ভিভিপিএটি হচ্ছে, ভোটার ভোট দেওয়ার পর ইভিএম থেকে একটি কাগজ বেরিয়ে আসবে। এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পাবেন। তবে কাগজটি ভোটার নিতে পারবেন না। ভিভিপিএটি না থাকায় নির্বাচন কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে, তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এটি পুনর্গণনা বা অডিট করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই নির্বাচন কমিশনের গঠন করা কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে সই করেননি।

ইসি নিজেই ইভিএমের পক্ষ-বিপক্ষ ঠিক করেছে

যেসব দল ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকটি দলকে ইভিএমের বিপক্ষে দেখানো হয়েছে, আবার কিছু দলকে পক্ষে দেখিয়েছে ইসি। যেমন ওয়ার্কার্স পার্টি, এনপিপি। এই দল দুটি ভিভিপিএটি যুক্ত করতে বলেছিল। কিন্তু ইসি দল দুটিকেই সরাসরি ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে। অন্যদিকে এনডিএম, খেলাফত মজলিসকে বিপক্ষে দেখিয়েছে, তারাও ভিভিপিএটি যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএমের পক্ষে থাকলেও তা শর্ত সাপেক্ষে। শর্তগুলো পূরণ করেই ইভিএম ব্যবহার করতে বলেছিল দলটি। তাদের বক্তব্য ছিল, ইভিএম নিয়ে জনমনে অনাস্থা ও সংশয় আছে। ইভিএম ‘হ্যাক’ (অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া) করা যায় না বলে ইসি যে দাবি করছে, তা প্রমাণিত নয়।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শর্ত সাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে। শর্তগুলো লিখিতভাবেই ইসিকে দেওয়া হয়েছে। এ শর্তগুলো পূরণ না করলে ইভিএমের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। ইসি যে সিদ্ধান্তই নিক, ওয়ার্কার্স পার্টি এই শর্তগুলোর বিষয়ে বলে যাবে।

জাকের পার্টি তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, ইভিএম পুরোপুরি নিরাপদ নয়। তারা বিকল্প একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে বলেছিল। কিন্তু ইসি এই দলকে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে।

জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও বিএনএফ শর্ত সাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে বলেছিল। আর নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পর সংলাপে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি (জেপি) ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। তবে এ দল দুটি শর্ত সাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছিল।

এসব দলের শর্তের মধ্যে ছিল ইভিএম নিয়ে বিতর্ক নিরসন, যান্ত্রিক ত্রুটি রোধ ও সব ধরনের জটিলতা নিরসন, অবৈধভাবে কেউ যাতে ইভিএম যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা, ইভিএম ব্যবহারে বৈষম্য না করা, আগে ইভিএম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করা ইত্যাদি।

বিএনএফের প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ইসি যদি মনে করে সংলাপে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা ইভিএমের পক্ষে তাহলে পক্ষে, আর যদি মনে করে বিপক্ষে, তাহলে বিপক্ষে।

ইভিএম থেকে সরে আসছে উন্নত দেশগুলোও

জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে ইসি। এখন তারা বলছে, যন্ত্রটির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এর আগে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শেষ দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।

তবে বুধবার নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইসি দাবি করেছে, সংলাপে বেশির ভাগ দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় এটি ব্যবহার না করা যুক্তিসংগত হবে না।

চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ এক বিবৃতিতে দেশের ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানান। তাঁরা ইভিএম ব্যবহারে ইসির নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেও উল্লেখ করেন। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইভিএম কিনতে বিপুল ব্যয় (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখারও অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা।

প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে উল্লেখ করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে।

ওই বিবৃতিতে সই করেছিলেন আমীর-উল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এম হাফিজউদ্দিন খান, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এম সাখাওয়াত হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, শাহদীন মালিক, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আসিফ নজরুল, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ বিশিষ্টজনেরা।

গত জুলাই মাসে নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ নয়টি দল। এসব দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে।

ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামত কমিশনের পাল্টে দেওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে নির্বাচন কমিশনকে মানুষের চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কমিশন প্রতারণা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাল্টে দেওয়ার ঘটনা অবিশ্বাস্য। নির্বাচন কমিশনাররা নিজে থেকেই বলছেন, তাঁরা আস্থার সংকটে আছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাঁদের সেই সংকট আরও প্রকট করবে।