ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা সূচক’ নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরল বিআইপি।
ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। বিশেষ করে গত এক দশকে অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ এক জায়গায় আটকে আছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম।
গতকাল বুধবার ‘বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে নগর–পরিকল্পনাবিদেরা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) গত ২৬ জুন ‘বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা সূচক’ প্রকাশ করেছে। সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদনের বিষয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বিআইপি।
বাসযোগ্যতার সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর ১৬৬তম অবস্থানে থাকলেও এবার ১৬৮ নম্বরে নেমে এসেছে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মতো সূচকের আলোকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর নিয়ে এই জরিপ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তাতে বলা হয়, ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সারা দেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদণ্ডে যথেষ্ট না।
বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৪৩। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ ১০০-তে পেয়েছে ২৬ দশমিক ৮। ২০১৯ সালেও বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে ২৬ দশমিক ৮ পেয়েছিল। অন্যান্য সূচকে কিছুটা কমবেশি হলেও অবকাঠামো সূচকে ধারাবাহিকভাবে একই নম্বর পাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের করাচি অবকাঠামো সূচকে পেয়েছে ৫১ দশমিক ৮ পয়েন্ট।
সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না।আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বিআইপি
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। সরকার বাসমালিকদের কাছে জিম্মি। এই শহরকে বাঁচাতে হলে উন্নত মানের বাস চালু করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মেগা প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। ফলে ঢাকায় টেকসই গণপরিবহনব্যবস্থা কার্যকর হয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছি, সেটার জবাব তারা দেয় না। অবকাঠামো খাতে চরমভাবে খারাপ করছে বাংলাদেশ। শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বাসগুলো যাত্রীর জন্য মারামারি করে এটাকে গণপরিবহন বলা যায় না। যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতেও বাসযোগ্যতায় খুব বেশি উন্নতি হবে না।’
ঢাকায় ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও বাসযোগ্যতায় অগ্রগতি হচ্ছে না মন্তব্য করে বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো পরিকল্পিত ও টেকসই হচ্ছে না।
বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। ১০০-তে দেশটির স্কোর ৯৮ দশমিক ৪। ঢাকার অবস্থান ভিয়েনার মতো করা সম্ভব হবে না বলে নগর–পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন। তবে তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ঢাকামুখী অভিগমনের হার কমানো এবং বাসযোগ্যতায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিকে থাকার কারণ নির্ধারণ করে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও টেকসই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সূচকে উন্নতি করা সম্ভব।
ঢাকার বাসযোগ্যতায় পিছিয়ে থাকার পেছনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর প্রকট সমন্বয়হীনতা অনেকাংশে দায়ী বলেন মনে করেন বিআইপির বোর্ড সদস্য মো. আবু নাইম সোহাগ। তিনি বলেন, গত এক দশকে ঢাকায় যানবাহন বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। কিন্তু সড়ক নেটওয়ার্ক বাড়েনি।
সমাপনী বক্তব্যে বিআইপির সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নগর সংস্থায় দুর্নীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল এবং নিজেদের নাগরিক অধিকারের জন্য যে শহরে আন্দোলন করতে হয়, সেখানে বাসযোগ্যতা কম থাকবেই। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরকে বাইপাস করে যাওয়ার কথা, সেটি শহরকে ধ্বংস করতে করতে যাচ্ছে। একটা শিশুপার্ক বছরের পর বছর বন্ধ। সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাসযোগ্যতায় কিছুটা উন্নতি সম্ভব।