প্রায় চার দশক ধরে চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলার মেলায় আসছেন গণেশ বৈরাগী। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়। বংশপরম্পরায় মণ্ডা-মিঠাইয়ের ব্যবসা তাঁদের। মিষ্টির পসরা নিয়ে এবারও এসেছেন গণেশ। এ মেলার সঙ্গে তাঁর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত। আগে আসতেন বাবা-কাকার সঙ্গে। এ মেলার টান তাই প্রবল তাঁর কাছে। এবারও মিঠাই, চুটকি, মণ্ডা—এমন নানা ধরনের শুকনা মিষ্টি নিয়ে গণেশ হাজির চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে। গণেশ বলছিলেন, ‘এবার মেলা ভালো জমবে মনে হয়।’
গণেশের মতো অনেকেরই আশা, এবারের জব্বারের বলীখেলার মেলা জমবে ভালো। কারণ, ঈদের আমেজে এবারের খেলা ও মেলা অন্য রকম এক মাত্রা পেয়েছে। তাই তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলা ঘিরে উচ্ছ্বাস বেড়েই চলেছে দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের।
লালদীঘির পাড়ে আবার জমেছে সেই মেলা। এক বছর পর আবার আসতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। এসেছেন ঝাড়ু, হাঁড়ি-পাতিল, দা-খুন্তি কিংবা হাতপাখার পসরা নিয়ে। কাল সোমবার শুরু হতে যাচ্ছে শতবর্ষী আবদুল জব্বারের বলীখেলার মেলা।
আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা বা বলীখেলা ও মেলার এবার ১১৪তম বর্ষে পা রাখছে। বকশীর হাটের সওদাগর আবদুল জব্বার ১৯০৯ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে এই বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। সেই থেকে প্রতিবছর এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং করনোর কারণে তিন বছর এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। গত বছরও রমজানের সময় মেলা হয়েছে স্বল্প পরিসরে।
তাই এবার ঈদের ছুটির মধ্যে মেলা ও খেলা উপভোগ্য হবে, এমন বিশ্বাস আয়োজকদের। আবদুল জব্বারের নাতি ও মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শওকত আনোয়ার বাদলের সঙ্গে আজ রোববার দুপুরে কথা হয় মেলা প্রাঙ্গণে। লালদীঘি মাঠে ইতিমধ্যে বলীখেলার রিং প্রস্তুত করা হয়েছে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি কাজের তদারক করছিলেন তিনি।
শওকত আনোয়ার বলেন, ‘মেলাটি চট্টগ্রামবাসীর ঐতিহ্য। ১৯৮৬ সাল থেকে বাপ-দাদার কাছ থেকে বংশানুক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এই মেলার আয়োজন করে যাচ্ছি প্রশাসনের সহায়তায়। লালদীঘি মাঠ সংস্কারের কারণে গত বছর বলীখেলা হয়েছিল রাস্তায় রিং বসিয়ে। এবার আবার বলীখেলা তার আপন ঘরে ফিরছে। বলীরা ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দোকানিরা আসতে শুরু করেছেন। এবার ঈদের আমেজে বলীখেলা ও মেলা অনুষ্ঠিত হবে।’
লালদীঘি মাঠকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় এই মেলা বসে। মঙ্গলবার লালদীঘি মাঠে হবে বলীখেলা। এর পরদিন বুধবার অনুষ্ঠিত হবে চাঁটগাঁইয়া ঈদ উৎসব। এবারের মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। মেলা শুরুর আগেই শনিবার রাত থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেছেন।
প্রতিবারের মতো এবারও মেলায় এসেছেন ঢাকার দীপু শেখ। তিনি গৃহসজ্জার মাটির টব, ব্যাংক, শোপিস ইত্যাদি নিয়ে শনিবার রাতেই এসেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর মেলায় আসি। এবারও এলাম। তবে এবার জিনিসপত্র কম সংগ্রহ করতে পেরেছি। মাটির জিনিসপত্র পোড়ানোর সময়টাতে এবার বৃষ্টি ছিল, এ কারণে কুমারেরা বেশি পণ্য দিতে পারেননি।’
একইভাবে ঢাকার রুবেল মিয়াও মাটির জিনিসপত্র নিয়ে বসেছেন লালদীঘি পেট্রলপাম্পের ভেতরে। এক ট্রাক মালপত্র নিয়ে তিনিও শনিবার রাতে আসেন। তাঁর আশা, ঈদের কারণে এবার মেলায় মানুষ সমাগম ভালো হবে। জিনিসপত্রও কিনবেন দর্শনার্থীরা।
এই মেলা ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের একটা বছরের পরিকল্পনা থাকে। কারণ, এই মেলা থেকে ঘরের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত যাবতীয় সামগ্রী কিনে নেওয়া যায়। কী নেই এই মেলায়। শীতলপাটি, হাতপাখা, ঝাড়ু, খেলনা, গাছের চারা, তামা-কাঁসা-পিতলের সামগ্রী, দোলনা, গৃহসজ্জার সামগ্রী, দা-খুন্তি, আসবাব, খাবারসামগ্রী, মাছ ধরার জাল, মোড়া, পিঁড়ি আরও কত কি।
নরসিংদী থেকে রফিকুল ইসলাম মোড়া, জলচৌকি, মাছ ধরার ফাঁদসহ বেতের বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে এসেছেন। তাঁরা তিন-চারজন সবাই নরসিংদী থেকে এসেছেন একই ধরনের সামগ্রী নিয়ে। রফিকুল বলেন, ‘এই বলীখেলা ঘিরে অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। এখানে ভালো বেচাকেনা হয়। এবারও একইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। বেচাবিক্রি করে একেবারে বাড়ি ফিরব।’
ঝাড়ু নিয়ে বাঁশখালী থেকে এসেছেন তৌহিদ ও মান্নান। তাঁরা দুজনেই তিন থেকে চার শ জোড়া ঝাড়ু এনেছেন। মেলায় ঝাড়ু বেশি চলে। কারণ, সবাই বছরের ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়ু একসঙ্গে সংগ্রহ করে থাকেন। হাতপাখার কদরও কম নয়। তালপাতা ও বেতের, উভয় হাতপাখার দেখা মিলছে জব্বারের বলীখেলায়। গরমের দিনে এই হাতপাখা প্রশান্তি এনে দিতে পারে, এমনটি বলছেন বিক্রেতা আবদুল খালেক।